রোহিঙ্গাদের শিবিরের বাইরে যাবার সুযোগ দিতে মানবাধিকার সংগঠনের আহ্বান

আহম্মদ ফয়েজ ও আবদুর রহমান
2022.02.08
ঢাকা ও কক্সবাজার
রোহিঙ্গাদের শিবিরের বাইরে যাবার সুযোগ দিতে মানবাধিকার সংগঠনের আহ্বান পার্শ্ববর্তী একটি শিবিরে আগুন লাগার পর কক্সবাজার উখিয়ার ক্যাম্প ৮ই’র বাসিন্দা রোহিঙ্গারা নিজেদের মালপত্র নিয়ে পানির ধারে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।
[তারিখবিহীন এই ছবিটি বার্মা হিউম্যান রাইটস নেটওয়ার্ক এর ‘আমাদেরও স্বপ্ন আছে’ প্রতিবেদন থেকে নেয়া]

নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের উচ্চশিক্ষা ও কাজের সুযোগ দেবার জন্য শরণার্থী শিবিরের বাইরে যাওয়ার একটি উপায় বের করতে বাংলাদেশের প্রতি আহবান জানিয়েছে বার্মা হিউম্যান রাইটস নেটওয়ার্ক (বিএইচআরএন)।

কক্সবাজারের শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের নানা সংকট নিয়ে তৈরি “আমাদেরও স্বপ্ন আছে” শিরোনামে গবেষণা প্রতিবেদনে এই দাবি করা হয়। মঙ্গলবার থাইল্যান্ডের ফরেন করেসপন্ডেন্ট ক্লাবের ক্লাব হাউজ থেকে সরাসরি ও ভার্চুয়ালি প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে বিএইচআরএন।

এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রতি ১২টি সুপারিশের পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি পাঁচটি এবং মিয়ানমারের প্রতি তিনটি সুপারিশ রাখে সংগঠনটি।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, “বাংলাদেশের উচিত শিবিরের ভেতরে ও বাইরে স্বাধীনভাবে চলাচলের অধিকার নিশ্চিত করা। শিবির ঘিরে কাঁটাতারের বেড়াসহ অন্যান্য বিপজ্জনক বেড়া সরিয়ে ফেলা।”

“রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তৃতীয় দেশে স্থানান্তরের বিষয়ে বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে সহযোগিতা করা,” বলা হয় প্রতিবেদনে।

এতে আরো বলা হয়, “শিবিরের দায়িত্বে নিয়োজিত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগগুলোকে অবশ্যই তদন্ত করতে হবে।”

শিবিরগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো জোরদার করার দাবি জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয় বাংলাদেশের উচিত বার্মার গণতান্ত্রিক গ্রুপগুলোকে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের সাথে কাজ করা, যাতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন তরান্বিত হয়।

প্রতিবেদনটি তৈরি করতে বিএইচআরএন ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে গত বছরের এপ্রিল পর্যন্ত কক্সবাজারের ১০টি রোহিঙ্গা শিবিরে ১৪ থেকে ৬০ বছর বয়সের ২৯ জন রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছে।

এই সাক্ষাৎকারে অংশ নেওয়া রোহিঙ্গাদের ৯৩ ভাগ জানিয়েছেন তাঁরা খাদ্য সমস্যায় ভুগছেন এবং ৭২ ভাগ বলেছেন তাঁরা ক্যাম্পের নিরাপত্তা নিয়ে সন্তুষ্ট নন।

সাক্ষাৎকারে অংশ নেওয়া প্রত্যেকেই নাগরিকত্ব নিয়ে নিজ দেশে ফিরতে আগ্রহী এবং তাঁদের মধ্যে ৮১ ভাগ মনে করেন সন্ত্রাসী কার্যক্রম শিবিরে একটা বড়ো সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সাক্ষাৎকারে অংশ নেওয়া ৩০ বছর বয়সী এক নারী বিএইচআরএনকে বলেন, “যে খাবার পাই তা আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়। শুধুমাত্র খাদ্য চাহিদা নিবারণের জন্য আমাদের একে অন্যের কাছে ঋণ করতে হয়।”

একই বয়সী অপর এক নারী বিএইচআরএনকে বলেন, “আমরা এবং আমাদের শিশুরা এখানে নিরাপদ নই। এখানে থেকে পর্যাপ্ত শিক্ষার সুযোগ পাওয়া যায় না।”

শিবিরের বাইরে গেলে স্থানীয়দের সাথে গোলযোগের আশঙ্কা

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত বেনারকে বলেন, “যেহেতু আমাদের দেশে মিয়ানমারের পাঠ্যক্রমে পরিচালিত কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই সেহেতু রোহিঙ্গাদের জন্য এখানে ক্যাম্পের বাইরে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করার সুযোগ নেই।”

রোহিঙ্গাদের শরণার্থী শিবিরের বাইরে স্বাধীন চলাফেরার বিষয়ে তিনি বলেন, “দাবি তোলা সহজ, কিন্তু এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের ব্যবস্থাপনা খুব সহজ কাজ নয়। রোহিঙ্গাদের অবাধে ক্যাম্পের বাইরে চলাফেরা করতে দিলে স্থানীয়দের সাথে গোলযোগ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।”

খাদ্য সমস্যার “তথ্য মোটেও সত্য নয়,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “উল্টো এখানে অনেক রোহিঙ্গা তাদের খাবার অবৈধভাবে স্থানীয়দের কাছে বিক্রি করছে।”

ঘনবসতি হওয়ায় রোহিঙ্গাদের নানা সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এসব সমস্যা সমাধানে প্রত্যাবাসন যেন দ্রুত হয় সেজন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরো জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।”

শরণার্থী শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ৮-এপিবিএন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) মো. কামরান হোসেন বেনারকে বলেন, “নিরাপত্তায় নিয়োজিত সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সত্য নয়। কেউ যদি কোনো অপরাধ করে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।”

নিজেদের দায়িত্বে থাকা শিবিরগুলো অনেকটা অপরাধমুক্ত দাবি করে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “বলা চলে শিবিরে বসবাসকারীরা আগের চেয়ে এখন অনেক নিরাপদে আছেন।”

“আগের তুলনায় অপহরণের ঘটনা নেই বললে চলে,” যোগ করেন তিনি।

কাজের সুযোগ পেলে জীবনমানের উন্নতি সম্ভব

কক্সবাজারের শিবিরে রোহিঙ্গা ইয়ুথ এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা কিন মং বেনারকে বলেন, “ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করা ও কাজ করার দাবি আমাদের অনেক পুরনো। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার আমাদের এই দাবি মানছে না।”

“বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করতে পারলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অনেক উপকার হতো। কাজ করার সুযোগ পেলে আমাদের জীবনমানের কিছুটা উন্নতি করা সম্ভব,” যোগ করেন তিনি।

আগের তুলনায় কমলেও অপহরণের ঘটনা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি দাবি করে তিনি বলেন, “শিবিরে আমরা এখনো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।”

“এটিও সত্য যে, শিবিরে যারা সংখ্যায় বেশি, তারা প্রাপ্ত রেশন নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে,” বলেন এই রোহিঙ্গা নেতা।

তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র সমাধান হচ্ছে মৌলিক অধিকার নিয়ে নিজ দেশে ফিরে যাওয়া।

প্রতিবেদন বিষয়ে জানতে চাইলে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচআর) নেত্রী জামালিদা বেগম জানান, শিবিরে তারা প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এখানে তাদের জন্য পরিকল্পিত কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই।

“ঘনবসতি শিবিরে পুরুষদের মতো আমাদেরও এখানে লড়াই করতে হচ্ছে। আমাদের জীবন হুমকির মুখে। এখন একটাই দাবি-মৌলিক অধিকার নিয়ে নিজ দেশে ফিরে যাওয়া অথবা তৃতীয় কোনো দেশে আমাদের পাঠানোর ব্যবস্থা করা,” যোগ করেন এই রোহিঙ্গা নেত্রী।

মিয়ানমারের সেনাদের অভিযান থেকে প্রাণে বাঁচতে দেশটির রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় শরণার্থী শিবিরগুলোতে বসবাস করছেন। এদের বেশিরভাগই ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নৃশংস অভিযানের সময় এসেছিলেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।