টেকনাফে অপহৃত পাঁচ রোহিঙ্গা নেতা, একদিন পর তিনজন উদ্ধার

আবদুর রহমান
2021.02.11
কক্সবাজার
টেকনাফে অপহৃত পাঁচ রোহিঙ্গা নেতা, একদিন পর তিনজন উদ্ধার নিজের ঘরের সামনে ছেলের ফেরার অপেক্ষায় টেকনাফের শরণার্থী শিবির থেকে অপহৃত রোহিঙ্গা নেতা সাব্বির আহমদের বাবা হারুন রশিদ। ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১।
[আবদুর রহমান/বেনারনিউজ]

টেকনাফের একটি শরণার্থী শিবির থেকে বুধবার দুপুরে নিখোঁজ পাঁচ রোহিঙ্গা নেতার (মাঝি) মধ্যে তিনজনকে বৃহস্পতিবার বিকেলে উখিয়া থেকে উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। 

বাকি দুজনকে বৃহস্পতিবার রাত দশটা পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

কক্সবাজার টেকনাফের হোয়াইক্যং এলাকার উনচিপ্রাং শিবির থেকে ক্যাম্প-ইন-চার্জের (সিআইসি) সাথে বৈঠকের উদ্দেশ্যে পার্শ্ববর্তী চাকমারকুল শিবিরে যাওয়ার কথা বলে বুধবার ঘর থেকে বের হয়েছিলেন ওই পাঁচ নেতা। 

অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা বুধবার দুপুর দুইটার দিকে তাঁদেরকে অপহরণ করে নিয়ে যায় বলে বেনারকে জানান আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক (পুলিশ সুপার) মো. তারিকুল ইসলাম। 

তিনি বলেন, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় তাঁদের তিনজনকে উদ্ধার করা হয়েছে।

“উখিয়ার ১৪ নম্বর (হাকিমপাড়া) ক্যাম্পের এ-ফোর ব্লক থেকে উদ্ধারের পর তাঁদেরকে পালংখালী আর্মি ক্যাম্পে রাখা হয়েছে। বাকি দুইজন কোথায় আছে তা এখনো জানা যায়নি,” বলেন তিনি। 

উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গা নেতারা হলেন সাব্বির আহমদ (৪২), মো. ইউসুপ (৩২) ও আবু মুছা (২৯)। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন মো. রফিক (৪২) ও আমান উল্লাহ (৪৫)। 

ওই রোহিঙ্গা নেতাদের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে মৌখিক অভিযোগ পেলেও এখন পর্যন্ত কোনো সাধারণ ডায়েরি (জিডি) বা মামলা হয়নি বলে এর আগে বেনারকে জানিয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট শরণার্থী শিবিরের এপিবিএন পুলিশ চৌকির ইনচার্জ রাকিবুল ইসলাম। 

প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর ছোট ছোট অংশের (ব্লকের) দায়িত্বে থাকা হেড মাঝি ও মাঝিদের মাধ্যমে শরণার্থীদের খাদ্যসামগ্রীসহ নানা পণ্য পৌঁছানো হয়। 

একই দিনে পাঁচজন অপহৃত হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে শরণার্থী বিষয়ক গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরুর) নির্বাহী ড. সি আর আবরার বেনারকে বলেন, “এটা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। রোহিঙ্গাদের দেখভালের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর অবশ্যই আরো বেশি তৎপর হওয়া দরকার।” 

“এই ধরনের ঘটনা শুধু রোহিঙ্গা শিবির নয়, ওই এলাকার স্থানীয় জনগণ, তথা পুরো এলাকার সার্বিক নিরাপত্তার জন্যই হুমকি। এর সাথে জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে তাঁদের শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন,” বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই অধ্যাপক। 

“তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকে অবশ্যই নিয়মের মধ্যে থেকে এই কাজটি করতে হবে,” উল্লেখ করে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, “নিকট অতীতে ওই এলাকায় যতগুলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার বেশিরভাগ ভিকটিম ছিল রোহিঙ্গারা।” 

আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত সভার জন্য বের হয়ে অপহৃত

উদ্ধার হওয়া সাব্বিরের পিতা হারুন রশিদ (৬৫) বৃহস্পতিবার দুপুরে বেনারকে জানান, বুধবার দুপুরে চাকমারকুল রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সিআইসির সঙ্গে বৈঠকের কথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যান তিনি। তাঁর সঙ্গে এই ক্যাম্পের আরো চারজন মাঝি ছিলেন। রাতেও ঘরে ফেরেননি তারা, মোবাইল ফোনগুলো বন্ধ ছিল। 

“আমার খুব ভয় হচ্ছিল। না জানি আমার ছেলে কোথায়-কেমন আছে,” বেনারকে জানান হারুন রশিদ। সন্ধ্যায় সাব্বিরকে উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। 

ইউসুপের স্ত্রী শামসুন নাহার (৩০) বেনারকে বলেন, “আমার স্বামী সিআইসির সাথে মিটিংয়ের কথা বলে বেরিয়ে আর ফিরে আসেনি। অনেকবার ফোন করেছিলাম। কিন্তু মোবাইল বন্ধ পেয়েছি।” ইউসুপও বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় উদ্ধার হন। 

“রোহিঙ্গা নেতারা ক্যাম্পে মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়ে আসছিল। এরই জের ধরে হয়তবা সশস্ত্র ডাকাতেরা তাঁদের ধরে নিয়ে গেছে,” বলেন সাব্বিরের পিতা। 

উল্লেখ্য, গত ১০ জানুয়ারি চাকমারকুল ক্যাম্পে দুই দল সশস্ত্র রোহিঙ্গার মধ্যে গোলাগুলির ঘটনায় নুর হাকিম (২৭) নামে একজন নিহত এবং ২৩ জন আহত হয়েছিল। 

২১ ও ২২ নম্বর শিবিরের সিআইসি রাশেদুল হাসান জানান, বুধবারের সভাটি ছিল ২২ নম্বর ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিষয়ক। ওই ক্যাম্পে সড়কের কাজ চলছে। তাই সেখানকার মাঝিদের ২১ নম্বর ক্যাম্পে আনিয়ে সভা করা হয়েছিল। 

“নিখোঁজদের পরিবারের পক্ষ থেকে বিষয়টি মৌখিকভাবে আমাকে জানানো হয়েছে। তাঁদের উদ্ধারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো কাজ করছে,” বেনারকে বলেন তিনি। 

রোহিঙ্গা অপহরণ নতুন নয়

গত বছরের সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গা নেতারা এক মাসে অর্ধশতাধিক ব্যক্তি অপহৃত হওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। 

উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত এপিবিএন কর্মকর্তারাও ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বেনারকে বলেছিলেন, মুক্তিপণ আদায়ের জন্য এমন কিছু ঘটনার ঘটেছে। তবে এবার কী কারণে এই অপহরণের ঘটনা ঘটেছে তা নিয়ে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। 

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এপিবিএন কর্মকর্তা তারিকুল বলেন, “এই মুহূর্তে কিছুই বলা যাচ্ছে না। আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখছি।” 

ড. সি আর আবরার বেনারকে বলেন, “সব মাঝি বা হেড মাঝি রোহিঙ্গাদের সমর্থন নিয়ে নেতৃত্বে আসছে, তা কিন্তু নয়। কর্তৃপক্ষ নিজেদের পছন্দের লোককে এই দায়িত্ব দিয়ে দিচ্ছে। যে কারণে তাদের ওপর অনেকের রাগ-ক্ষোভ থাকে।” 

“এক্ষেত্রে রোহিঙ্গারা যদি মাঝি বা হেড মাঝি নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারত তবে তাঁদের সামাজিক অবস্থান ও নিরাপত্তা আরো পোক্ত হতো,” মনে করেন তিনি। 

প্রতিবেদনে ঢাকা থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন শরীফ খিয়াম।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।