সাগরে রোহিঙ্গাদের মৃত্যু: মানবপাচারে অভিযুক্ত ১৯ জনের ১৮ জনই বাংলাদেশি

আবদুর রহমান ও শরীফ খিয়াম
2020.02.12
কক্সবাজার ও ঢাকা
200212_Human_trafficking-Rohingya_1000.jpg গ্রেপ্তার আট অভিযুক্ত মানবপাচারকারীকে টেকনাফ থেকে কক্সবাজার কারাগারে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২০।
[আবদুর রহমান/বেনারনিউজ]

বঙ্গোপসাগরে মালয়েশিয়াগামী ট্রলার ডুবে ১৫ রোহিঙ্গার প্রাণহানির ঘটনায় বুধবার সকালে কক্সবাজারের টেকনাফ মডেল থানায় ১৯ পাচারকারীকে অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে আটজনকে আটকের কথা জানিয়েছে পুলিশ।

জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্তি পুলিশ সুপার মোহাম্মদ (এএসপি) ইকবাল হোসাইন বেনারকে বলেন, “আটক পাচারকারীদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। মানবপাচারে জড়িতদের বিষয়ে আরো তথ্য আদায়ের জন্য তাঁদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।”

“পলাতক অভিযুক্তদের ধরতেও অভিযান অব্যাহত রেখেছে পুলিশ,” বলেন তিনি।

মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে কোস্টগার্ডের টেকনাফ কন্টিনজেন্ট কমান্ডার এস এম ইসলামের দায়ের করা মামলায় অবৈধভাবে সাগরপথে মানবপাচার ও অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে ট্রলার ডুবিয়ে মানুষ হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, উখিয়া বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা মো. ওসমান (৩০) ছাড়া অভিযুক্ত ১৮ জনই বাংলাদেশি। এই মামলায় টেকনাফের নোয়াখালীয়া পাড়ার বাসিন্দা সৈয়দ আলমকে (২৮) প্রধান আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

নৌকাডুবিতে জীবিত উদ্ধার হওয়াদের মধ্যে চারজনকে দালাল হিসেবে মঙ্গলবার গ্রেপ্তার করে কোস্টগার্ড। এরা হলেন টেকনাফ নোয়াখালী পাড়ার ফয়েজ আহম্মদ (৪৮) ও আজিজ (৩০), টেকনাফ সদরের সৈয়দ আলম (২৭) ও বালুখালীর ওসমান (৩০)।

“কোস্টগার্ডের হাতে আটক হওয়া পাচারকারীদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বাকি চারজনকে নোয়াখালী পাড়া থেকে আটক করা হয়েছে,” বেনারকে বলেন টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাস।

ওই মামলায় আটক বাকি চারজন হলেন নোয়াখালী পাড়ার হুমায়ুন কবির (২০), মোহাম্মদ করিম (৪৯) এবং জুম্মা পাড়ার সাদ্দাম হোসেন (২০) ও মোহাম্মদ রফিক (২৬)।

আরো একজন জীবিত উদ্ধার

সেন্টমার্টিনের কাছাকাছি কোরালের ধাক্কায় টেকনাফ থেকে মালয়েশিয়াগামী ওই ট্রলার ডুবির ঘটনায় মঙ্গলবার ১৫ রোহিঙ্গার মৃতদেহ এবং চার দালালসহ ৭২ জনকে জীবিত উদ্ধার করে কোস্টগার্ড।

পরে বুধবার সকালে সাগরে আরো একজনকে জীবিত অবস্থায় পাওয়ার কথা উল্লেখ করে কোস্টগার্ডের টেকনাফ স্টেশনের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ সোহেল রানা বেনারকে জানান, মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ নামের ওই যুবককে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।

উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গাদের দেওয়া তথ্যমতে ওই নৌকায় মোট ১৩৮ জন যাত্রী ছিলেন বলে জানান তিনি। সে হিসেবে ৫০ জন রোহিঙ্গা এখনও নিখোঁজ রয়েছেন।

“জাহাজ, হেলিকপ্টার, স্পিড বোট ও ট্রলার নিয়ে নিখোঁজদের উদ্ধারে অভিযান চালাচ্ছে কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী,” বলেন সোহেল রানা।

জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এবং শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) এই দুর্ঘটনাজনিত ক্ষয়ক্ষতিতে দুঃখ প্রকাশ করে মঙ্গলবার এক বিবৃতি প্রকাশ করেছে।

জাতিসংঘের সবগুলো সংস্থা এবং তাদের সহযোগী সংস্থাগুলো বেঁচে থাকা মানুষের প্রয়োজনের প্রতি সাড়া দিতে সরকারকে সহায়তা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছে বলে জানানো হয় ওই বিবৃতিতে।

এ ব্যাপারে ইউএনএইচসিআর মুখপাত্র মোস্তফা মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বেনারকে বলেন, “শুকনো বা গরম খাবার, আশ্রয়, আইনি সহায়তা প্রদান করে সাহায্য করতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি।”

উল্লেখ্য, জীবিত উদ্ধার হওয়া শরণার্থীদের টেকনাফ থানার মাধ্যমে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে।

মানবপাচার চলছেই

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) জেষ্ঠ্য গবেষক ড. জালাল উদ্দিন শিকদার বেনারকে বলেন, “সম্প্রতি কক্সবাজারে আমি টানা দুই মাস থেকে এসেছি। সেখানে দেখেছি সাগরপথে মানবপাচার আসলে একটা চলমান প্রক্রিয়া।”

“মাঝখানে বিষয়টি হয়ত গণমাধ্যমে আসেনি, কিন্তু এটা কখনোই থামেনি, চলছিল। এখন সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যজনকভাবে ট্রলার ডুবির এই ঘটনার কারণে বিষয়টি আবার প্রকাশ্যে এসেছে,” বলেন তিনি।

তাঁর দাবি, এক্ষেত্রে যারা বেশি টাকা দিতে পারে, তারা ভালো ট্রলারে নিরাপদে যেতে পারে। আর যারা কম টাকা দিয়ে খারাপ ট্রলারে যায়, তারাই দুর্ঘটনার শিকার হয়। টাকার পরিমাণের ওপর নির্ভর করে কে কেমন ট্রলারে যাবে।

২০১২ থেকে ১৬ সালের মধ্যে অবৈধভাবে সমুদ্রপথে বিদেশ যেতে গিয়ে সারা বিশ্বে এক হাজার ৮০০ মানুষ মারা গিয়েছে, যার মধ্যে কমপক্ষে ৮০০ জন বাংলাদেশ থেকে রওনা হয়েছিল বলেও জানান এই গবেষক।

বিগত দুই বছরে কক্সবাজারের পাঁচ মানবপাচারকারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যাওয়ার কথা উল্লেখ করে ড. জালাল বলেন, “এটা সামাজিক সমস্যা। এ জাতীয় ‘বন্দুকযুদ্ধের’ মাধ্যমে এর সমাধান করা যাবে না।”

তবে এএসপি ইকবাল বেনারকে বলেন, “মানবপাচার রোধে আমরা জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছি। সে অনুযায়ীই সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”

“মানবপাচার ঠেকাতে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এবং আশেপাশের স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হবে,” বলেন তিনি।

কক্সবাজারের শরণার্থী এবং স্থানীয় মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে জাতিসংঘও সরকারের সাথে কাজ করে যাচ্ছে জানিয়ে আইওএম এবং ইউএনএইচসিআর বলছে, সেখানে এ ধরনের নৌকাডুবির ঘটনা নতুন নয়।

পরিস্থিতি সামলাতে আইন প্রয়োগের সক্ষমতা জোরদার করার প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করেছে তারা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।