১৭ দিনেও সন্ধান মেলেনি নিখোঁজ খ্রিস্টান রোহিঙ্গা পরিবারের

আবদুর রহমান ও শরীফ খিয়াম
2020.02.13
কক্সবাজার ও ঢাকা
200213_Christian_Rohingya_1000.jpg উখিয়ার কুতুপালং শিবিরের খ্রিস্টান পল্লিতে হামলার শিকার হওয়া ঘরগুলো পুনরায় নির্মাণ করা হচ্ছে। ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০।
[আবদুর রহমান/বেনারনিউজ]

কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবির থেকে নিখোঁজ হওয়ার ১৭ দিন পরও খ্রিস্টান রোহিঙ্গা তাহের ও তাঁর পরিবারের খোঁজ মেলেনি। গত ২৭ জানুয়ারি নিখোঁজ হওয়া এই পরিবারের পরিণতি নিয়ে উদ্বিগ্ন তাঁর সম্প্রদায়ের শরণার্থীরা।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) ট্রানজিট সেন্টারে আশ্রয় নেওয়া খ্রিস্টান রোহিঙ্গা জোহার (২৮) বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “তাহের, মিজান, তাঁদের পরিবারের ১৪ বছরের একটি মেয়েসহ কাউকেই আমরা এখনও খুঁজে পাইনি। পুলিশকে বলেছি, ক্যাম্প ইনচার্জকে জানিয়েছি, কিন্তু কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।”

তবে একইদিন কুতুপালং নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক সমীর চন্দ্র সরকার বেনারকে বলেন, “তদন্তে কোনো খ্রিস্টান রোহিঙ্গা নিখোঁজ হওয়ার সতত্যা পাওয়া যায়নি। তবুও নিখোঁজ পরিবারটির সন্ধান পেতে আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি।”

এর আগে গত ২৮ জানুয়ারি বেনারকে তাহেরের পরিবার নিখোঁজ হওয়ার খবরটি জানান খ্রিস্টান রোহিঙ্গা সাইফুল ইসলাম পিটার। মিয়ানমারের মুসলিম জঙ্গি গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সদস্যরা তাঁদের ধরে নিয়ে গেছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।

পরে ২৯ জানুয়ারি বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়ার (আরএফএ) কাছে খ্রিস্টান রোহিঙ্গা কমিউনিটির পক্ষ থেকে পাঠানো এক ই-বার্তায়ও একই অভিযোগ করে জানানো হয়, নিখোঁজ পরিবারের চার সদস্যের নাম তাহের, খুরশিদা, মিজান এবং মরিয়ম।

অপহরণকারীদের মুখ ঢাকা ছিল বলেও উল্লেখ করেন তাঁরা।

তবে পুলিশ ও মুসলিম রোহিঙ্গাদের ভাষ্যমতে, গত ২৬ জানুয়ারি দিবাগত সাড়ে ১০টার দিকে কুতুপালং ক্যাম্পের খ্রিস্টান পল্লির ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় আবদুর শুক্কুর (২৫) নামের এক মুসলিম রোহিঙ্গাকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে পিটারের নেতৃত্ব মারধর করা হয়। যার জেরে রাত ১২টার পর হামলা চালায় ক্ষিপ্ত মুসলিম রোহিঙ্গারা।

শুরু থেকেই এ ঘটনার সাথে আরসার সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে আসছে পুলিশ।

এদিকে গত ১১ ফেব্রুয়ারি আরসার টুইটার পাতায় সংগঠনের কমান্ডার ইন চিফ আবু আমর জুননির পক্ষ থেকে প্রচারিত এক অডিও বার্তায়

দাবি করা হয় মিয়ানমারে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য আরসা হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান সকল রোহিঙ্গার পক্ষে লড়াই করে যাচ্ছে।

“যদি কেউ মনে করে যে, আরসা শুধু মুসলিম রোহিঙ্গাদের জন্য সংগ্রাম করে তবে ভুল করা হবে, বরং আরসার লড়াই সকল ধর্মের সকল রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ের জন্য,” বলা হয় ওই অডিও বার্তায়।

ধর্মের পার্থক্য থাকলেও সকল রোহিঙ্গা জাতিগতভাবে একই উল্লেখ করে নিজেদের মধ্যে বিভেদ তৈরি না করে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানানো হয় এই বিবৃতিতে।

প্রসসঙ্গত, সরকার বাংলাদেশে আরসার উপস্থিতি বরাবরই অস্বীকার করে থাকে। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গাদের অপহরণ ও নির্যাতনের অভিযোগে বিভিন্ন সময় আরসাকে দায়ী করেছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, ২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে ১০০ হিন্দু রোহিঙ্গাকেও হত্যা করেছে এই আরসা।

ক্যাম্পে ফিরতেনা

সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হয়ে ট্রানজিট সেন্টারে আশ্রয় নেওয়া খ্রিস্টান পরিবারগুলোকে পুনরায় কুতুপালং ক্যাম্পের খ্রিস্টান পল্লিতে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে সেখানে পুনরায় মুসলিম রোহিঙ্গাদের হাতে অত্যাচারিত হওয়ার ভয়ে খ্রিস্টানরা ফিরতে চাচ্ছেন না।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের কর্মকর্তা মো. খলিলুর রহমান খান বেনারকে বলেন, “খ্রিস্টানদের শিবিরে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য ইউএনএইচসিআর-এর সহায়তায় নতুন করে ঘর নির্মাণের কাজ চলছে।”

এ ব্যাপারে ইউএনএইচসিআর মুখপাত্র মোস্তফা মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বেনারকে বলেন, “ট্রানজিট সেন্টারে আশ্রয় নেওয়া খ্রিস্টান শরণার্থীরা শিগগিরই তাঁদের শিবিরে ফিরে যাবেন। ইতিমধ্যে আমরা তাঁদের আশ্রয়কেন্দ্রগুলো পুনর্নির্মাণ শুরু করেছি।”

তবে ট্রানজিট ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া আনোয়ার (২০) নামের খ্রিস্টান রোহিঙ্গা বেনারকে বলেন, “কুতুপালং শিবিরে খ্রিস্টান রোহিঙ্গারা অনিরাপদ। সেখানে বারবার আরসার রোষানলে পড়তে হবে।”

তবে “সরকারের পক্ষে থেকে সেখানে তাঁদের সেখানে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়া হবে,” বলে জানান খলিলুর রহমান খান।

হামলার পরদিন ২৭ জানুয়ারি সকালে ১৭টি খ্রিস্টান পরিবারকে ইউএনএইচসিআর-এর ট্রানজিট সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে আরো পাঁচটি পরিবার সেখানে এসে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে সেখানে ২২টি পরিবারের ৮৭ জন খ্রিস্টান রয়েছেন।

গত ২৯ জানুয়ারি খ্রিস্টান রোহিঙ্গারা ৫৯ জন মুসলিম রোহিঙ্গাকে এবং মুসলমানরা ১৩ জন খ্রিস্টান রোহিঙ্গাকে অভিযুক্ত করে উখিয়া থানায় পাল্টাপাল্টি মামলা করেন। মামলা দুটির তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক সমীর চন্দ্র সরকার।

তিনি জানান, খ্রিস্টান পল্লিতে হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে এখন পর্যন্ত ১৪ মুসলিম রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।