রোহিঙ্গা শিবিরের পথে মালয়েশিয়ার ত্রাণ
2017.02.14

প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে পৌঁছেছে মালয়েশিয়া সরকারের পাঠানো ত্রাণ। গত সোমবার প্রায় দেড় হাজার টন ত্রাণবাহী মালয়েশিয়ার জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ত্রাণসামগ্রী খালাস করে গতকালই সড়কপথ ট্রাকযোগে কক্সবাজার নেওয়া হয়। বুধবার রোহিঙ্গাদের মধ্যে এসব ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রতিক সহিংসতা শুরু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত প্রায় ৬৬ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁদের সহায়তার লক্ষ্যে এসব ত্রাণ পাঠিয়েছে মালয়েশিয়া।
স্থানীয় জেলা প্রশাসনের সহায়তায় ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করবে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) ও বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। সকল আলোচনার অবসান ঘটিয়ে মালয়েশিয়া থেকে আসা ২৫জন স্বেচ্ছাসেবককে বাংলাদেশে ত্রাণ কাজে অংশ নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে সরকার।
এর আগে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিমকে সহায়তা দিতে গত ৩ ফেব্রুয়ারি মালয়েশিয়ার পোর্ট ক্ল্যাং থেকে যাত্রা করে ৮ ফেব্রুয়ারি ইয়াঙ্গুন পৌঁছায় ত্রাণবাহী জাহাজটি। ত্রাণ সামগ্রীর মধ্যে ছিল ইনস্ট্যান্ট নুডলস, বোতলজাত পানি এবং প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম।
জাহাজটি ৯ ফেব্রুয়ারি ইয়াঙ্গুন বন্দরে পৌঁছায়। সেখানে বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী মিয়ানমারের নাগরিকেরা রোহিঙ্গা-বিরোধী প্রতিবাদ মিছিল করে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ জাহাজটিকে রাখাইনের রাজধানী সিত্তে যাওয়ার অনুমতি দিতে অস্বীকার করে। তারা জাহাজের ২৩০ জন স্বেচ্ছাসেবীর কাউকে ইয়াঙ্গুন বন্দরে নামার অনুমতি দেয়নি। তবে ত্রাণসামগ্রী ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস দেয় দেশটির সরকার।
তুরস্কভিত্তিক টার্কি দিয়ানেত ভাকফি (টিডিভি) ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় পুত্রা ওয়ান মালয়েশিয়া ক্লাব ও মালয়েশিয়ান কনসালটেটিভ কাউন্সিল অব ইসলামিক অর্গানাইজেশন (এমপিআইএম) ত্রাণ সরবরাহের এই কাজ করছে।
জাহাজে আসা স্বেচ্ছাসেবী দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন পুত্রা ওয়ান মালয়েশিয়া ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা মালয়েশিয়ার এমপি আবদুল আজিজ বিন আবদুল রহিম এবং এমপিআইএমের প্রেসিডেন্ট এমপি মোহাম্মদ আজমি বিন আবদুল হামিদ।
ইয়াঙ্গুন থেকে রওয়ানা দিয়ে মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বাকি ত্রাণ নিয়ে ‘নটিক্যাল আলিয়া’ নামের জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে। পরে সংক্ষিপ্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য আনা ত্রাণসামগ্রী বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করে মালয়েশীয় কর্তৃপক্ষ।
পররাষ্ট্রসচিব খুরশেদ আলম বেনারকে বলেন, “ত্রাণসামগ্রী মঙ্গলবার রাতেই কক্সবাজারে পৌঁছে যাবে। আমরা এগুলো আইওএম’র কাছে তুলে দিয়েছি। রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সহায়তায় এগুলো ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। কাজগুলো ত্বরান্বিত করতে স্থানীয় জেলা প্রশাসনও সহায়তা দেবে।”
সচিব বলেন, “মালয়েশিয়ার ২৫ জন আগ্রহী স্বেচ্ছাসেবককে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। জাহাজটিতে আসা ১৮৩ জনের সবাই চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যেতে আগ্রহী হননি। এদের মধ্যে ৩৪ জন মঙ্গলবার রাতের ফ্লাইটে মালয়েশিয়া ফেরত যাচ্ছেন। বাকিরা বুধবার জাহাজে ফেরত যাবেন।”
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক আলী হোসেন বেনারকে বলেন, “ত্রাণসামগ্রী আমরা বুঝে পেয়েছি। চট্টগ্রাম থেকে ১৫০টি ট্রাকে করে এসব ত্রাণসামগ্রী টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলার বিভিন্ন গুদামে নিয়ে যাওয়া হবে। সেগুলো প্রায় ১৫ হাজার রোহিঙ্গা পরিবারের মাঝে বিতরণ করা হবে। এর মধ্যে টেকনাফে সাড়ে ৫ হাজার ও উখিয়ার ৯ হাজার পরিবার রয়েছে।”
“জাহাজটিতে এক হাজার ৪৭২টন ত্রাণ সামগ্রী রয়েছে,” এক প্রশ্নের জবাবে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তা।
জানা যায়, জাহাজটিতে করে মালয়েশিয়া, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, থাইল্যান্ড ও ফিলিস্তিনসহ বিভিন্ন দেশের সাংবাদিক, চিকিৎসক ও স্বেচ্ছাসেবকেরা এসেছেন।
নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয়, মালয়েশিয়া থেকে আসা ত্রাণ বিতরণ ও শরণার্থী ক্যাম্পে গিয়ে সেবাকাজে অংশ নিতে অনুমতি দেওয়ায় বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান মালয়েশীয় প্রতিনিধিরা।
মালয়েশীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা আবদুল আজিজ বিন আবদুল রহিম ওই অনুষ্ঠানে বলেন, “মালয়েশিয়ার জনগণের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করতে আমরা এসেছি। আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। ভবিষ্যতে ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গাদের কল্যাণে আমরা সহযোগিতা করতে চাই।”
রোহিঙ্গাদের সাহায্যে সরাসরি ত্রাণ পাঠানো প্রথম দেশ হিসেবে মালয়েশিয়ার এগিয়ে আসার প্রশংসা করেছে বাংলাদেশ সরকার। গত সোমবার মন্ত্রিসভা মালয়েশিয়া সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছে।
এ বিষয়ে শরণার্থী বিষয়ক বিশ্লেষক আসিফ মুনীর বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের জন্য ভিন্ন একটি দেশ থেকে ত্রাণসামগ্রী আসার বিষয়টি অত্যন্ত ইতিবাচক। কিন্তু সেগুলো অভাবগ্রস্ত এবং সঠিক মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে সরকার এবং আইওএম যথাযথ ভূমিকা রাখবে বলে সবাই প্রত্যাশা করে।”