পাঁচ রোহিঙ্গা নেতা অপহরণ: দুই বাংলাদেশিসহ ৫২ জনের বিরুদ্ধে মামলা

আবদুর রহমান ও শরীফ খিয়াম
2021.02.17
কক্সবাজার ও ঢাকা
পাঁচ রোহিঙ্গা নেতা অপহরণ: দুই বাংলাদেশিসহ ৫২ জনের বিরুদ্ধে মামলা অপহরণকারীদের কবল থেকে উদ্ধার হওয়া টেকনাফের উনচিপ্রাং রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা মো. ইউসুপ। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১।
[আবদুর রহমান/বেনারনিউজ]

টেকনাফের পাঁচ রোহিঙ্গা নেতাকে অপহরণের ঘটনায় অর্ধশত ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। 

অপহৃতরা সবাই উদ্ধার হলেও পরবর্তী প্রতিহিংসার ভয়ে তাঁদের কেউ মামলার বাদী হতে রাজি হননি। ফলে পুলিশকেই বাদী হয়ে এই মামলা করতে হয়েছে বলে বেনারকে জানান টেকনাফ মডেল থানার তদন্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হাফিজুর রহমান। 

তিনি জানান, তাঁর থানায় গত মঙ্গলবার দায়ের হওয়া ওই মামলায় দুই বাংলাদেশি, ৩০ রোহিঙ্গা ও অজ্ঞাত ২০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। 

শরণার্থী শিবিরগুলোতে অপরাধ এবং মাদক চোরাচালানের বিরুদ্ধে সক্রিয় থাকার কারণেই তাঁদের অপহরণ করা হয়েছিল বলে মনে করছেন অপহরণের শিকার পাঁচ রোহিঙ্গা নেতা। অপহরণের পর নির্যাতনের কারণে তাঁদের একজন এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। 

বেনারের কাছে এই মামলার এজাহারের অনুলিপি রয়েছে। বাংলাদেশি দুষ্কৃতিকারীরা অপহরণের পর মাঝিদের রোহিঙ্গা দুষ্কৃতিকারীদের হাতে তুলে দিয়েছে বলে এতে উল্লেখ রয়েছে। 

এজাহার অনুযায়ী গত ১০ ফেব্রুয়ারি দুপুরে পার্শ্ববর্তী চাকমারকুল শিবির থেকে নিজেদের বাসস্থান উনচিপ্রাং শিবিরে ফেরার পথে বাংলাদেশি দুই সন্ত্রাসী ও তাঁদের সহযোগীরা পাঁচ রোহিঙ্গা নেতাকে (মাঝি) বহনকারী সিএনজি অটোরিকশার গতি রোধ করে। 

এরপর অস্ত্রের মুখে তাঁদের একটি বাগানের মধ্যে নিয়ে রোহিঙ্গা দুস্কৃতিকারীদের হাতে তুলে দেয়।

“শুরুতে মোবাইলফোন কেড়ে নিয়ে অস্ত্র তাক করে আমাদের পাহাড়ের দিকে নিয়ে যায়। আমরা যেতে না চাইলে অনেক মারধর করে। এরপর চোখ বেঁধে ফেলা হয়,” সেদিনের ঘটনা প্রসঙ্গে বেনারকে বলেন অপহরণের শিকার রোহিঙ্গা নেতা সাব্বির আহমদ (৪২)। 

“এরপর একটি গাড়িতে তুলে উখিয়াতে নিয়ে যায়। রাতে একটি ঝুপড়িতে রেখে কিছু নাম জানতে চেয়ে মারধর করে,” বেনারকে বলেন অপহরণের শিকার অন্য রোহিঙ্গা নেতা মো. ইউসুপ (৩২)। 

অপহৃত সাব্বির, ইউসুপ ও আবু মুছাকে (২৯) ১১ ফেব্রুয়ারি উখিয়ার হাকিমপাড়ার একটি শরণার্থী শিবির থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। মো. রফিক (৪২) ও আমান উল্লাহকে (৪৫) অপহরণকারীরা ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে উখিয়ার বালুখালীর পানবাজার এলাকায় ছেড়ে যায় বলে উল্লেখ করা হয় এজাহারে। 

“আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দ্রুত অভিযান পরিচালনা না করলে আমাদের হয়ত মেরে ফেলা হতো,” বলেন ইউসুপ। 

“ক্যাম্পে চাঁদাবাজিসহ কোনো অপরাধ যাতে না ঘটে সে লক্ষ্যে আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। মূলত এই কারণে আমাদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল,” বেনারকে বলেন আবু মুছা। 

তিনি বলেন, “ক্যাম্পেও অপহরণকারীদের অনেক গোপন সংবাদদাতা রয়েছে। আমরা কী করছি না করছি সব নজরদারি করছে তারা। যে কারণে এখনো ভয়ের মধ্যে রয়েছি।” 

অপহরণের পর পাঁচজনের কাছ থেকে মোবাইল, অলঙ্কার, নগদ অর্থসহ প্রায় সাড়ে ৮৪ হাজার টাকার মালামাল লুট করেছে অভিযুক্তরা। একইসঙ্গে মারধর করে দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছে বলেও মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে। 

এর মধ্যে আমানকে হাতুড়ি দিয়ে গুরুতর আঘাত করেছে অপহরণকারীরা। তাঁর বড় ভাই নুরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “বর্তমানে সে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।” 

“আসামিদের ধরতে পুলিশ দ্রুত অভিযান পরিচালনা করবে,” বেনারকে জানান ওসির হাফিজুর রহমান।

‘অপরাধে জড়িত বাংলাদেশিরা ধরা পড়ছে কম’ 

বিশ্লেষকদের মতে, কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে অপহরণকারীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো। ফলে রোহিঙ্গা অপহরণের ঘটনা বেড়েই চলেছে।

এর মাঝে গত সপ্তাহে টেকনাফের পাঁচ শরণার্থী নেতাকে অপহরণের সূত্র ধরে রোহিঙ্গা অপহরণকারীদের সঙ্গে বাংলাদেশিদের সংশ্লিষ্টতার তথ্য বেরিয়ে এসেছে। 

উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম দেড় মাসের ১৯টি অপহরণের ঘটনায় ৩০ জন অপহৃতকে উদ্ধার করা হয়েছে এবং ২১ জন অপহরণকারী আটক হয়েছে। 

“কেউ অপহৃত হওয়ার খবর পেলে সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধার অভিযান চালানো হচ্ছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা অপহৃতদের উদ্ধার ও অপহরণকারীদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হচ্ছি,” বেনারকে বলেন এপিবিএন-১৬ এর অধিনায়ক পুলিশ সুপার (এসপি) মো. তারিকুল ইসলাম। 

“শিবিরগুলোর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আমরা সবসময় সর্তক রয়েছি,” বেনারকে জানান এপিবিএন-১৪ অধিনায়ক এসপি মো. আতিকুল ইসলাম। 

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী কমিটির মহাসচিব নূর খান লিটনের মতে, “শরণার্থী শিবির এলাকায় দীর্ঘদিন থেকেই রোহিঙ্গা সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা স্থানীয় বাংলাদেশি অপরাধীদের সাথে মিলেমিশে কাজ করছে। অপহরণের পাশাপাশি তারা ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসার মতো অপরাধও করছে।” 

“মাঝেমধ্যে রোহিঙ্গা অপরাধীরা আটক হলেও ক্যাম্পকেন্দ্রিক অপরাধে জড়িত বাংলাদেশিরা খুবই কমই ধরা পড়ছে,” বেনারকে বলেন তিনি। 

“আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি অপরাধীদের একই দৃষ্টিতে দেখতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের বৈষম্য আমাদের কাম্য নয়,” বেনারকে বলেন শরণার্থী বিষয়ক গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরুর) নির্বাহী ড. সি আর আবরার। 

টেকনাফে অপহরণ আতঙ্ক বেশি

উখিয়ার চেয়ে টেকনাফে অপহরণের ঘটনা বেশি হওয়ার বিষয়টি বেনারের কাছে নিশ্চিত করেছেন এসপি তারিকুল ও ওসি মো. হাফিজুর রহমান।

“পাহাড় সংলগ্ন আট শরণার্থী শিবির থেকে প্রায়ই অপহরণের খবর আসে,” জানিয়ে ওসি হাফিজুর বেনারকে বলেন, “সেখানকার অপহরণকারীদের নেটওয়ার্ক সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে।” 

“উনচিপ্রাং ক্যাম্পেই অপহরণের ঘটনা বেশি ঘটে। ক্যাম্পটি পাহাড়ি এলাকায় হওয়ায় অপরাধীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে,” বেনারকে বলেন রোহিঙ্গা ছাত্র ইউনিয়নের নেতা সৈয়দ উল্লাহ। 

গত সপ্তায় উনচিপ্রাং শিবির থেকে পাঁচ মাঝি অপহরণের ঘটনায় “সাধারণ রোহিঙ্গাদের আতঙ্ক বেড়ে গেছে,” জানান তিনি। 

“অপহরণকারী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর অবস্থান এবং শক্তি-সামর্থ্যের বিষয়টি এই মাঝিরা জানেন। যে কারণে তাঁরা এতটাই ভীত যে অপহৃত হওয়ার পরও মামলা করার সাহস হয়নি তাঁদের,” বেনারকে বলেন মানবাধিকার কর্মী লিটন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।