ফিরতে না চেয়ে শূন্যরেখায় আটকে পড়া রোহিঙ্গাদের বিক্ষোভ
2018.02.21
ঢাকা ও কক্সবাজার

সীমান্তের শূন্য রেখায় অবস্থানরত সাড়ে ছয় হাজার রোহিঙ্গাকে অচিরেই রাখাইনে ফেরত নেওয়া হবে—মিয়ানমারের এমন আশ্বাসের পরদিনই বুধবার বান্দরবানের তুমব্রু সীমান্তের জিরো পয়েন্টে আটকে পড়া রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসন বিরোধী বিক্ষোভ করেছেন।
রোহিঙ্গা নেতারা জানান, রাখাইনে ফিরে যাওয়ার আগে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনসহ ছয় শর্ত পূরণ না হলে মিয়ানমারে ফেরত না যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয় বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে।
এ নিয়ে গত এক সপ্তাহে ছয়বার তুমব্রু নো-ম্যান্স ল্যান্ডে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা বিক্ষোভ করেছেন বলে জানান বিক্ষোভের অন্যতম আয়োজক দিল মোহাম্মদ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এর আগে শনিবার ও সোমবার ছয় হাজার রোহিঙ্গার দফায় দফায় বিক্ষোভে উত্তপ্ত ছিল তুমব্রু সীমান্ত।
“আমাদের দাবি, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে হবে। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করতে হবে। প্রত্যাবাসনের আগে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিক মর্যাদা দিতে হবে,” বেনারকে বলেন দিল মোহাম্মদ।
তিনি আরও জানান, আন্তর্জাতিক সংস্থাকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। রোহিঙ্গাদের জায়গা-জমি ফেরত দিয়ে নিজ ঘরভিটায় ফেরত পাঠাতে হবে। রাখাইন রাজ্যে গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক সংস্থার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে।
“এসব দাবি পূরণ না হলে নো-ম্যান্স ল্যান্ডের রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফেরত যাবে না,” বলেন দিল মোহাম্মদ।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সফরে এসে মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিও সোয়ে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানান যে শূন্যরেখায় আটকে পড়া সাড়ে ছয় হাজার রোহিঙ্গাকে যত দ্রুত সম্ভব রাখাইনে ফেরত নেওয়া হবে।
তবে রোহিঙ্গাদের ভয়ের কিছু নেই জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ কোনো রোহিঙ্গাকে জোর করে ফেরত পাঠাবে না।”
তিনি বলেন, “তিনি (মিয়ানামার মন্ত্রী) আমাকে বারবার আশ্বস্ত করেছেন, শূন্যরেখায় আটকে পড়া মানুষসহ সকল রোহিঙ্গাকে তাঁরা ফেরত নেবেন। তিনি আমাকে আরও বলেছেন, তাঁরা কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালা ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করবেন।”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করলে রোহিঙ্গাদের শঙ্কা দূর হবে।”
এর আগে জানুয়ারির মাঝামাঝি কুতুপালং ও বালুখালি ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসন বিরোধী বিক্ষোভ করে। পরে পুলিশি বাধার মুখে তাঁরা আর বিক্ষোভ করতে পারেনি।
তাঁরা রাখাইন ফিরে যাওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে তাঁদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তার কথা বলেন।
শূন্যরেখায় আটকে পড়াদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে ২০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা মিয়ানমারের ঢেঁকিবুনিয়া সীমান্তের তংপিও লিতওয়ে নামক স্থানে বৈঠক করেন।
বাংলাদেশের ১২ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার আব্দুল মান্নান। বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলে আরো ছিলেন বিজিবি কক্সবাজার সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল আব্দুল খালেক, কক্সবাজার ও বান্দরবানের জেলা প্রশাসকসহ বিজিবি ও সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিরা।
মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলে ছিলেন মংডুর ডেপুটি কমিশনার ইউ ইয়ে হুড, ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা, পুলিশ, বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) ও গোয়েন্দা শাখার কর্মকর্তারা।
বান্দরবান জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক বলেন, “যেহেতু তুমব্রু নো-ম্যানস ল্যান্ডে অবস্থানকারী রোহিঙ্গারা এখনও বাংলাদেশে প্রবেশ করেনি তাই আমরা সেখানে অবস্থানকারী সাড়ে ছয় হাজার রোহিঙ্গাকে স্বদেশে ফিরিয়ে নিতে বিজিপির কাছে প্রস্তাব রাখি।”
“তারা আমাদের প্রস্তাবটি চিন্তাভাবনা করে দেখবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে কবে তাঁদের ফিরিয়ে নেওয়া হবে সে ব্যাপারে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়নি,” জানান তিনি।
নো-ম্যান্স ল্যান্ড থেকে পালাচ্ছে রোহিঙ্গারা
মঙ্গলবারের বৈঠকের পরও তুমব্রু সীমান্তের নো-ম্যান্স ল্যান্ড থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসছে রোহিঙ্গারা।
মঙ্গলবার রাতে প্রায় দেড় শতাধিক রোহিঙ্গা নোম্যান্স ল্যান্ড ছেড়ে পালিয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন সেখান থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা আব্দুল মালেক।
তিনি জানান, মিয়ানমার সেনাবাহিনী গত কয়েক দিন ধরে জিরো লাইনে থাকা রোহিঙ্গাদের মাইকিং করে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে বলছে, রাতে ফাঁকা গুলি ছুড়ে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে।
“রাতে সেনা সদস্যরা নো-ম্যান্স ল্যান্ডে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেছে। এতে আতঙ্কিত হয়ে হামলার আশঙ্কায় অনেক রোহিঙ্গা পালিয়ে কুতুপালং ও বালুখালি ক্যাম্পে চলে আসছে,” বলেন আব্দুল মালেক।
সীমান্তে বিজিবির কড়া পাহারা থাকায় রাতের আঁধারে লুকিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে নো-ম্যান্স ল্যান্ডে আটকে পড়া রোহিঙ্গারা।
বিজিবি’র সতর্ক পাহারার ভেতরেও লুকিয়ে গত দুইদিনে অন্তত তিন’শ রোহিঙ্গা নো-ম্যান্স ল্যান্ড ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন বিজিবি’র একজন কমান্ডার।
আটকে পড়া রোহিঙ্গাদের মাঝি মোহাম্মদ ইউসুফ বেনারকে বলেন, “মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনে নতুন করে পারিখা খনন করছে। নতুন করে সেনা সমাবেশ ঘটাচ্ছে।”
তিনি জানান, মিয়ানমার যেকোনো সময় হামলা করবে এই ভয়ে অনেক রোহিঙ্গা রাতের আঁধারে জিরো পয়েন্টের রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছেড়েছে। আর যারা এখনো নো-ম্যান্স ল্যান্ডে অবস্থান করছেন তাঁরা খুবই আতঙ্কে দিন পার করছেন।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীদের প্রস্তুতি দেখে আরও একটি রোহিঙ্গা নির্যাতনের আশঙ্কার কথা জানিয়ে ইউসুফ বলেন, “আমরা এদিক সেদিক যাওয়ার সাহস পাচ্ছি না।”
“মিয়ানমার বাহিনীর আচরণ সন্দেহজনক। তারা যেকোনো কিছু করতে পারে আমাদের সঙ্গে। তারা আমাদের সঙ্গে গোপন বৈঠকের কথাও বলেছিল কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া আমরা কোনো বৈঠকে বসব না জানিয়েছি,” বলেন ইউসুফ।