সাগরে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা উদ্ধারের আহবান জাতিসংঘের
2021.02.22
ঢাকা ও কক্সবাজার

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একটি নৌকা আন্দামান সাগরে আটকা পড়েছে দাবি করে যত দ্রুত সম্ভব সংলগ্ন দেশগুলোকে তাঁদের উদ্ধার করার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর।
সোমবার প্রকাশিত বিবৃতিতে সংস্থাটি জানিয়েছে, ইঞ্জিন চালিত নৌকাটির সবাই প্রায় ১০ দিন আগে বাংলাদেশের কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে যাত্রা শুরু করে।
নৌযানটিতে কত শরণার্থী ছিলেন তা ইউএনএইচসিআর নিশ্চিত না করলেও ওই নৌকাটিতে নারী ও শিশুসহ প্রায় ৯০ জন রোহিঙ্গা ছিলেন বলে যাত্রীদের বরাত দিয়ে সোমবার বেনারকে জানিয়েছেন রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার সংগঠন আরাকান প্রজেক্টের কর্মকর্তারা।
এদের মধ্যে অন্তত আটজন যাত্রী মারা গেছেন বলে জানান তাঁরা।
নৌকায় ভাসমান রোহিঙ্গা ও তাঁদের স্বজনদের সাথে শনিবার থেকে সংগঠনটি যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে বলে সোমবার বেনারকে জানান আরাকান প্রজেক্টের ডিরেক্টর ক্রিস লেওয়া।
নৌকার যাত্রীদের বরাত দিয়ে লেওয়া জানান, এখন পর্যন্ত ওই নৌকার ছয় জন নারী ও দুইজন পুরুষ মারা গেছেন। যার মধ্যে শনিবারে মারা গেছেন দুই নারী ও এক পুরুষ।
“তাঁদের (নৌকার যাত্রীদের) ভাষ্যমতে, নৌকাটিতে ৬৫ জন নারী, দুই বছরের কম বয়েসি পাঁচটি শিশু ও ২০ জন পুরুষ ছিলেন,” বেনারকে বলেন লেওয়া।
নৌকাটি গত ১১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ উপকূল থেকে সমুদ্রপথে রওয়ানা দেবার দুদিন পর ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়ায় সমুদ্রে ভাসছিল বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, “খাবার ও পানি শেষ হয়ে যাবার পর তৃষ্ণায় তাঁদের অনেকে সাগরের পানি খেয়েছেন।”
ভারতের আন্দামান-নিকোবার দ্বীপের কাছে ভাসমান ওই নৌকাটিকে দেশটির নৌবাহিনী চিহ্নিত করেছে বলে সোমবার এক প্রতিবেদনে জানায় বার্তাসংস্থা রয়টার্স।
ভারতীয় নৌবাহিনী নৌকার যাত্রীদের খাদ্য ও পানি সরবরাহ করেছে জানিয়ে লেওয়া বলেন, তাঁর আশা ওই রোহিঙ্গাদের ভারত সরকার উপকূলে ভিড়তে দেবে।
“তবে মূলত ওই সিদ্ধান্ত নয়াদিল্লীর ভারতীয় সরকারই গ্রহণ করবে, নৌবাহিনী নয়,” বলেন লেওয়া।
আন্দামান সাগরে ভাসমান ওই রোহিঙ্গাদের বিষয়ে ভারতীয় নৌবাহিনী পরবর্তীতে বিবৃতি প্রকাশ করবে বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
কোনো রোহিঙ্গা নেবে না বাংলাদেশ
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেছেন, বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া বাংলাদেশের পক্ষে আর কোনো নতুন রোহিঙ্গা নেওয়া সম্ভব নয়।
সোমবার নিজ কার্যালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৮৪ হাজার মানুষ বাস করে। বিশ্বের কোথাও এমনটি আছে?”
“আমরা যথেষ্ট নিয়েছি। এখন অন্য দেশগুলোকে তাঁদের (রোহিঙ্গাদের) নিতে বলেন। আমরা আর নিতে পারব না,” বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
এর আগেও আন্দামান সাগরে ভাসমান একদল রোহিঙ্গা শরণার্থীকে উদ্ধারের আবেদন করেছিল ইউএনএইচসিআর।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের পক্ষে অতিরিক্ত রোহিঙ্গা নেওয়া এখন আর সম্ভব না। এটা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বোঝা শুধু নয়, দেশের নিরাপত্তার জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ।”
“রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য জাতিসংঘকে এখন অন্য জায়গা খুঁজে নিতে হবে,” বলেন তিনি।
‘আরো প্রাণহানি হতে পারে’
ইউএনএইচসিআরের দাবি, নৌযানটিতে আটকেপড়া শরণার্থীদের শারীরিক অবস্থা খুবই শোচনীয় এবং তাঁরা মারাত্মক পানি শূন্যতায় ভুগছেন। এরই মধ্যে কয়েকজন প্রাণ হারিয়েছে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি। গত ২৪ ঘণ্টায় আরও কয়েকজন প্রাণ হারাতে পারেন বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ইউএনএইচসিআর।
বিবৃতিতে বলা হয়, নৌযানটিতে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা জানিয়েছেন, কয়েক দিন আগেই খাবার এবং পানি শেষ হয়ে গেছে। সপ্তাহ খানেক আগে নৌযানটির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে সেটি সাগরে ভাসমান অবস্থায় রয়েছে।
সুনির্দিষ্ট কোনো দেশের সাথে যোগাযোগ না করে সংস্থাটি ওই সমুদ্র এলাকার সব রাষ্ট্রকে এ বিষয়ে সতর্ক করেছে। এর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট দেশের নিয়ন্ত্রণে থাকা জলসীমায় নৌযানটি পাওয়া গেলে রোহিঙ্গাদের উদ্ধার করে আশ্রয় দেওয়ার আহবান জানিয়েছে ইউএনএইচসিআর।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, শরণার্থী ও অভিবাসীদের ঝুঁকিপূর্ণ এই সাগর যাত্রা অব্যাহত থাকার বিষয়টি অনুসন্ধান করে তাঁদের উদ্ধার করে এবং ফিরিয়ে আনতে দ্রুত আঞ্চলিক সম্মিলিত প্রয়াস জরুরি হয়ে পড়েছে।
নৌকা যাত্রার কথা জানা নেই বাংলাদেশের
চলতি মাসের ১০ তারিখের দিকে বাংলাদেশ উপকূল থেকে কোনো নৌযান সাগরে যাত্রা করার তথ্য জানা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. মামুনুর রশিদ বেনারকে বলেন, “দেশের সীমান্তে সকল আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা খুব সর্তক অবস্থানে থাকায় এখান থেকে রোহিঙ্গা বোঝাই ট্রলার (ইঞ্জিন চালিত নৌকা) যাবার সুযোগ নেই।”
ওই নৌকাযাত্রা সম্পর্কে একই ধরনের মন্তব্য করে কোস্ট গার্ডের চট্টগ্রাম পূর্ব জোনের স্টাফ অফিসার (অপারেশন) লে. কমান্ডার হাবিবুর রহমান, বেনারকে বলেন, “এ ব্যাপারে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই।”
“এমনও হতে পারে ট্রলারটি মিয়ানমার থেকে গেছে। তবু বিষয়টি আমরা দেখছি,” বলেন জেলা প্রশাসক মামুনুর রশিদ।
আন্দামান সাগরে রোহিঙ্গা বোঝাই ট্রলারের খবর জেনেছেন জানিয়ে রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ উল্লাহ বেনারকে বলেন, “তবে তারা কক্সবাজারের কোন কোন ক্যাম্প থেকে রওনা দিয়েছে সেটি বলা যাচ্ছে না।”
সম্প্রতি শরণার্থী শিবির থেকে কেউ সাগরপথে রওয়ানা দিয়েছে কি না সে সম্পর্কে সংবাদ সংগ্রহের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
সাধারণত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা উন্নত জীবনের আশায় সাগরপথে মালয়েশিয়া যাবার চেষ্টা করেন। তবে এই নৌকার যাত্রীদের গন্তব্য কোথায় ছিল তা জানা যায়নি।
এদিকে সাগরে ভাসমান রোহিঙ্গা বোঝাই ওই নৌকাটির তথ্য জানা নেই বলে জানিয়েছেন মালয়েশিয়ার কর্মকর্তারাও।
টেকনাফের উনচিপ্রাং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা মো. ইদ্রিস জানান, প্রায় বিশ দিন আগে তাঁর ক্যাম্প থেকে দুটি পরিবার অন্যত্রে আশ্রয় নিতে যাওয়ার কথা বলে বের হয়। তাঁরা আসলে অন্য কোথাও আশ্রয় নিয়েছেন, নাকি সাগর পাড়ি দিয়েছেন, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলে জানান ইদ্রিস।
এর আগে তাঁর ক্যাম্প থেকে কিছু রোহিঙ্গা নৌকায় দিয়ে পাড়ি দিয়েছিল। পরে তাঁদের উদ্ধার করে ভাসানচরে নেওয়া হয়েছিল জানিয়ে মো. ইদ্রিস বলেন, “আন্দামান সাগরে ভাসমান ট্রলারেও আমাদের ক্যাম্পের লোকজন থাকার বিষয়টি অস্বাভাবিক নয়।”
এর আগে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশ জলসীমায় ফিরে আসা ৩০৬ জন রোহিঙ্গাকে গত বছরের মে মাসে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে নোয়াখালী জেলার ভাসানচরে নেয়া হয়।
এসব রোহিঙ্গা কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরে ফিরতে চাইলেও সে বিষয়ে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
এর মধ্যে কক্সবাজারের ঘিঞ্জি শরণার্থী শিবির থেকে এক লাখের মতো রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত ডিসেম্বর থেকে প্রায় দশ হাজার রোহিঙ্গাকে দ্বীপটিতে স্থানান্তর করেছে সরকার।