রোহিঙ্গা শিবিরে সশস্ত্র দুই গ্রুপের সংঘর্ষে দুই শিশু গুলিবিদ্ধ

আহম্মদ ফয়েজ
2023.02.22
ঢাকা
রোহিঙ্গা শিবিরে সশস্ত্র দুই গ্রুপের সংঘর্ষে দুই শিশু গুলিবিদ্ধ কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরে নিরাপত্তায় সাদা পোশাকে দায়িত্ব পালন করছেন পুলিশ সদস্যরা। ২৩ আগস্ট ২০২২।
[সুনীল বড়ুয়া/বেনারনিউজ]

বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরে বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপের মধ্যে একের পর এক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেই চলছে। সর্বশেষ বুধবার সশস্ত্র দুই গ্রুপের সংঘর্ষে দুই রোহিঙ্গা শিশু গুলিবিদ্ধ হয়েছে।

এর আগে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, শরণার্থী শিবিরগুলোতে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনসহ (আরএসও) ১১টি সক্রিয় সশস্ত্র দুর্বৃত্ত দল সক্রিয় রয়েছে।

বৈঠকে এই তালিকাসহ একটি গোপনীয় প্রতিবেদন উত্থাপন করা হয়েছে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। প্রতিবেদনটির একটি কপি বেনারের হাতে এসেছে, যেখানে বলা হয়েছে, সশস্ত্র দলগুলোর মধ্যে আরসার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বেশিরভাগ ক্যাম্পে।

প্রতিবেদনে অনুযায়ী, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তের শূন্য রেখায় অবস্থিত তমব্রু কোনাপাড়া ক্যাম্পটিতে নিয়মিত টহল ও নজরদারি জোরদার করতে না পারার কারণে সেটি আরসার সাংগঠনিক কার্যক্রম, প্রশিক্ষণ, মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

প্রতিবেদন মতে শিবির এলাকায় “আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র সশস্ত্র দলগুলো “প্রায়ই মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।”

২০২১ সালে ও ২০২২ সালে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে ৬৪টি হত্যাকাণ্ড হয়েছে জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে ২২টি এবং ২০২২ সালে ৪২টি হত্যাকাণ্ড হয়েছে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে।

আরসার উপস্থিতি ও তাদের সন্দেহভাজন কার্যক্রম নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি করেছে বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনটিতে।

সংঘর্ষে ২ শিশু গুলিবিদ্ধ

কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা শিবিরে সন্ত্রাসী দুই দলের মধ্যে সংঘর্ষে বুধবার দুই রোহিঙ্গা শিশু গুলিবিদ্ধ হয়েছে।

“দুপুর একটার দিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ৮ নম্বর ওয়েস্টের এ ব্লকে দুই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলি ও সংঘর্ষ শুরু হয়। আধা ঘণ্টা ধরে চলা এই সংঘর্ষে ক্যাম্পের দুই শিশু গুলিবিদ্ধ হয়,” বেনারকে জানান উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী।

আহতদের প্রথমে উখিয়া এমএসএফ হাসপাতালে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর জেলা সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।

“ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার করতে দুটি গ্রুপ গোলাগুলি ও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়,” বলেন ওসি।

এদিকে সাম্প্রতিক সময় বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে শূন্যরেখায় মিয়ানমারের আরসা ও আরএসও সদস্যদের মধ্যে প্রকাশ্যে সংঘর্ষে জড়ানোর পর থেকে দুটি গ্রুপ ক্যাম্পে নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে বেনারকে জানান বালুখালী শিবিরের স্বেচ্ছাসেবী মোহাম্মদ হারুন।

দুটি দলের এই আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আরো “গোলাগুলির ঘটনা ঘটতে পারে,” বলে আশঙ্কা করেন তিনি।

নিজেদের মধ্যে সংঘাতে লিপ্ত

প্রতিবেদনে থাকা সশস্ত্র দুর্বৃত্ত দলগুলো সম্পর্কে বেনার কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা ও শিবিরের সাধারণ শরণার্থীর সঙ্গে কথা বলেছে। তাঁরা বলছেন, শিবিরগুলোতে মূলত আরসা, আরএসও এবং ইসলামী মাহাজ নামের তিনটি সংগঠন বেশ সক্রিয়। অন্য দলগুলো মূলত মাদক কারবার, ডাকাতি ও চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত।

এ প্রসঙ্গে রোহিঙ্গা ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা খিন মং বেনারকে বলেন, আরসা, আরএসও এবং ইসলামী মাহাজ “সাধারণ রোহিঙ্গাদের বুঝাতে চায় যে তারা রোহিঙ্গাদের স্বার্থে কাজ করছে।”

তবে সাধারণ রোহিঙ্গারা এই ধরনের সকল সন্ত্রাসী সংগঠনেরই বিরুদ্ধে জানিয়ে তিনি বলেন, “এসব সংগঠনের কর্মকাণ্ডের কারণে অনেক সাধারণ রোহিঙ্গাও নিপীড়নের শিকার হয়।”

“সশস্ত্র দলগুলো প্রতিনিয়তই নিজেদের মধ্যে সংঘাতে লিপ্ত হয়। এর ফলে ঝুঁকির মধ্যে পড়েন সাধারণ শরণার্থীরা। অনেক সময় পুলিশ এসব দলের সদস্য মনে করে অনেক সাধারণ শরণার্থীকেও গ্রেপ্তার করে,” বেনারকে বলেন আরকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মুহাম্মদ জুবায়ের।

কুতুপালং এ বসবাসকারী এক শরণার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “এই সন্ত্রাসী দলগুলো প্রতিনিয়তই অরাজকতা তৈরি করে। তারা ক্যাম্পের বাহিরের লোকদের সঙ্গে মিলে মাদক ব্যবসা করে এবং ক্যাম্পে অপহরণ ও লুটপাট চালায়।”

এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন মুহাম্মদ জুবায়ের।

তবে তাঁর মতে, সন্ত্রাসী দলগুলোর বিরুদ্ধে সক্রিয়তা দেখাতে গিয়ে যেন সাধারণ নিরপরাধ রোহিঙ্গারা হয়রানির শিকার না হন।

নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর শিবিরগুলোতে সক্রিয় সশস্ত্র দলগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।

“আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত টহল দিচ্ছে, বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছে এবং কাঁটাতারের বেড়া দিয়েও অপরাধ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে এই সশস্ত্র দলগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে,” বেনারকে বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

তিনি বলেন, এসব সন্ত্রাসী দলের কাজে যারাই বাধা হয়ে দাঁড়ায় তারা তাঁদেরকে হত্যার মিশনে নামে। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকজন মাঝি (নেতা) এবং রাত্রিকালীন স্বেচ্ছা প্রহরীকে খুন করেছে সশস্ত্র দলগুলো।

বর্তমানে প্রায় ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশের কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ও তার আশেপাশে বসবাস করছেন। যাদের মধ্যে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা ২০১৭ সালে মিয়ানমার সরকারের রক্তক্ষয়ী দমন-পীড়ন থেকে বাঁচার জন্য দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।

প্রতিবেদন তৈরিতে কক্সবাজার থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আবদুর রহমান

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।