রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে যুক্তরাষ্ট্রকে বিশেষ দূত নিয়োগ দিতে বাংলাদেশের পরামর্শ
2021.02.24
ঢাকা
রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ। একইসঙ্গে এই সংকট নিরসনে রোহিঙ্গা বিষয়ক একজন বিশেষ দূত নিয়োগ করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বাংলাদেশ আহবান জানিয়েছে।
মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেনের সঙ্গে এক টেলিফোন আলোচনায় এই আহ্বান জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সরকারের সাথে এটিই ছিল উচ্চ পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রথম আলোচনা।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে বিবৃতিতে বলা হয়, “যুক্তরাষ্ট্রের উচিত রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নেতৃত্বের ভূমিকায় আসা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করতে উদ্যোগী হওয়া, যাতে টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের ওপর যথেষ্ট রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা সম্ভব হয়।”
“বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে অনুকূল পরিবেশ তৈরির জন্য মিয়ানমারের ওপর চাপ তৈরি করতে যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা বিষয়ক একজন বিশেষ দূত নিয়োগ করতে পারে বলেও পরামর্শ দেন ড. মোমেন,” বলা হয় বিবৃতিতে।
মিয়ানমারের কয়েকজন ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে ধন্যবাদ জানিয়ে ড. মোমেন দেশটির উপর কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে মিয়ানমারের পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত অগ্রাধিকার বা জিএসপি সুবিধা উঠিয়ে নেওয়ার সুপারিশও করেন বলে উল্লেখ রয়েছে বিবৃতিতে।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামার পর পরিস্থিতি সামাল দিতে অব্যাহত মানবিক ও রাজনৈতিক সহায়তার জন্য ড. মোমেন যুক্তরাষ্ট্রকে ধন্যবাদ জানান।
প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্রই সবচে বড়ো দাতা দেশ। ২০১৭ সালের আগস্টের পর রোহিঙ্গাদের জন্য দেশটি এক হাজার দুইশ' কোটি (১.২ বিলিয়ন) ডলার সহায়তা দিয়েছে, যার মধ্যে বেশিরভাগই বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য।
তবে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, কয়েকজন পদস্থ সেনা কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের আহ্বানে যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের উদ্যোগ নিলেও তা ফলপ্রসূ নাও হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক এহসানুল হক বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র খুব একটা কার্যকর ভূমিকা নিতে পারবে বলে মনে হয় না। এর চেয়ে চীন ও ভারতের ভূমিকা বেশি জরুরি। কারণ, মিয়ানমারের উপর চাপ প্রয়োগের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এই দুটো দেশের সক্ষমতা বেশি রয়েছে।”
“ভারত ও চীনের সাথে বর্তমান মিয়ানমার সামরিক সরকারের ভালো বোঝাপড়া আছে, যেটা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নেই। সব সময় গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের পক্ষে অবস্থান নেওয়া যুক্তরাষ্ট্র সেনা অভ্যুত্থান ইস্যুতে সরাসরি মিয়ানমারের বিরোধিতা করছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের হাত ধরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ফলপ্রসূ কিছু আসবে না,” বলেন তিনি।
“তবে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি,” জানিয়ে তিনি বলেন, “সেজন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর সাথে ভালো কূটনৈতিক যোগাযোগ রেখে এই সংকট সমাধানের চেষ্টা করে যেতে হবে, যাতে ইস্যুটা হারিয়ে না যায়।”
তিন দিনের সফরে সোমবার যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ব্লিনকেনের সঙ্গে তাঁর সরাসরি বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও কোভিড-১৯ স্বাস্থ্যবিধির কারণে টেলিফোনে আলোচনা হয় দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর।
মিয়ানমারে রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস দেন বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আলোচনায় রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই সমাধানের বিষয়টি উঠে আসার কথা জানানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের এক বিবৃতিতেও।
“দুই নেতা রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটের একটি টেকসই সমাধান এবং শ্রম ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার বিষয়ে আলোচনা করেছেন,” এতে বলা হয়।
দুই নেতা দক্ষিণ এশিয়া ও বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করারও ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন বলেও উল্লেখ রয়েছে বিবৃতিতে।
কৌশলগত সম্পর্ক তৈরির ইচ্ছা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কৌশলগত স্তরে নেওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন দুদেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতাদের সফরের ওপর জোর দেন।
ড. মোমেন আশা প্রকাশ করেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দ্রুত বাংলাদেশ সফর করবেন। ব্লিনকেনকে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ জানান তিনি।
দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে আরও গভীর করার আগ্রহ ব্যক্ত করেন। দুই দেশের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করা এবং বৈশ্বিক বিষয়ে সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য দুই নেতা সম্মত হন।
রোহিঙ্গা সঙ্কটের বাইরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানো, করোনাভাইরাস পরবর্তী সময়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারসহ কৌশলগত বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে আলোচনা হয় বলে জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দুই নেতা অর্থনৈতিক সহযোগিতা, সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা আরো জোরদার করার উপায় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো অভিন্ন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় একসাথে কাজ করার বিষয়ে আলোচনা করেছেন।