প্রতিশ্রুতি ছাড়া দেশে ফিরতে রাজি না রোহিঙ্গারা
2022.02.25
মিয়ানমারের সামরিক জান্তা অবিলম্বে জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতি নিচ্ছে- এমন ঘোষণার পর বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বলেছেন, সমান অধিকার এবং চলাচলের স্বাধীনতা না দেওয়া পর্যন্ত তাঁরা রাখাইন রাজ্যে ফিরবেন না।
মিয়ানমার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০ ফেব্রুয়ারি এক বিবৃতিতে বলেছে, তারা “রাখাইন রাজ্য থেকে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিবর্গকে” প্রত্যাবাসনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তবে তারা ‘রোহিঙ্গা’ অথবা ‘বাঙালি’ শব্দ দুটির কোনোটিই ব্যবহার করেনি।
প্রসঙ্গত, মিয়ানমার সরকার কখনো রোহিঙ্গাদের জাতিগত পরিচয় ‘রোহিঙ্গা’ কথাটা ব্যবহার করে না। তারা রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে।
বিবৃতিতে অ্যাসোসিয়েশন অফ সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস (আসিয়ান) এর সেক্রেটারি জেনারেলের সাথে একটি বৈঠকেরও আহ্বান জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, রাখাইন রাজ্যে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের পুনরায় দেশে ফেরানোর বিষয়ে আসিয়ান ব্লকের প্রাথমিক সুপারিশগুলিতে সম্মত হওয়ার পর তা বাস্তবায়নের জন্য সহায়তা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বৃহস্পতিবার বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়াকে বলেছেন, জান্তা ওই সুপারিশ অনুযায়ী কাজ করবে, এ ব্যাপারে তাদের কোনো আস্থা নেই। স্বদেশে ফিরে আসার আগে তাদের অধিকার সুরক্ষিত করা হবে এমন নিশ্চয়তা প্রয়োজন।
কক্সবাজারের বালুখালী শরণার্থী শিবিরের বসবাসরত রোহিঙ্গা আলী জেনার বলেছেন, তিনিসহ শিবিরের কারো “জান্তার প্রতি মোটেও আস্থা নেই।”
“রোহিঙ্গারা যদি সেখানে অন্য নাগরিকদের মতো সমান নাগরিকত্ব, নিরাপত্তার অধিকার, সমান অধিকার এবং সমস্ত মৌলিক অধিকার পায় তাহলে আমরা ফিরে যেতে রাজি হতে পারি,” বলেন তিনি।
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া ২০১৯ সালের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে নৃশংস দমন-পীড়নের মাধ্যমে কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে বিতাড়ন ও গণহত্যার অভিযোগে মামলা করে।
মিয়ানমারের ওই বিবৃতির পরদিন গত ফেব্রুয়ারি ২১ আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংসতা চালানোর অভিযোগগুলো গণহত্যার পর্যায়ে পড়ে কিনা, তা খতিয়ে দেখার এখতিয়ার ওই আদালতের আছে কিনা তা নির্ধারণের জন্য শুনানি শুরু করেছে।
ফেব্রুয়ারি ২৮ পর্যন্ত এই শুনানি চলবে। এতে মিয়ানমার ও গাম্বিয়া উভয় পক্ষের প্রতিনিধিদের যুক্তি শোনা হবে।
জান্তার আইনজীবী ক্রিস্টোফার স্টেকার এবং স্টেফান তালমন যুক্তি দিয়েছেন, গাম্বিয়া ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) পক্ষে মামলা করেছে। ওআইসি কোনো দেশ না হওয়ায় ওই আবেদন শুনানির এখতিয়ার আদালতের নেই। তাছাড়া গাম্বিয়া সংক্ষুব্ধ রাষ্ট্র না হওয়ায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করার অধিকারও তাদের নেই।
তবে গাম্বিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল দাউদা জালো ফেব্রুয়ারি ২৩ তারিখ আদালতকে বলেছেন, শুধুমাত্র রোহিঙ্গাদের অধিকার রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে মামলাটি আনা হয়নি; জাতিসংঘের গণহত্যা সংক্রান্ত কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে গাম্বিয়া তার অধিকার সমুন্নত রাখার জন্য এই আবেদন করেছে।
আশাবাদী রোহিঙ্গারা
আন্তর্জাতিক আদালতে ন্যায়বিচার পাবেন বলে আশাবাদী বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। তবে এই মামলাটি অদূর ভবিষ্যতে জান্তাকে কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে তা নিয়ে সতর্ক অবস্থান অন্যদের।
আন্তর্জাতিক চাপের প্রতিক্রিয়ায় জান্তা সরকার যে বিবৃতি দিয়েছে তা বিশ্বাস করেন না বলে জানিয়েছেন রোহিঙ্গা যুব ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশের থিনখালীর ১৩ নম্বর শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারী খিন মং।
“তারা আমাদের ফেরত নিতে চায়, একে স্বাগত জানাই। কিন্তু তারা কি আমাদের রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করেছে? এটিই আমাদের ভাবা উচিত,” বলেছেন তিনি।
“জান্তা প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং তাঁর সুবিধার জন্য আমাদের ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন। সদিচ্ছার কারণে নয়, আন্তর্জাতিক চাপের কারণে তিনি এমনটা করছেন। আমাদের ফেরত নেওয়ার সিদ্ধান্ত যেই নিক না কেন, আমরা ফিরে যেতে প্রস্তুত। তবে আমাদের প্রয়োজনীয়তা পূরণ না হলে দেশে ফেরা অসম্ভব।”
খিন মং বলেন, “নাগরিকত্ব বা নিরাপত্তা ও চলাফেরার স্বাধীনতার নিশ্চয়তা ছাড়া রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরে যাওয়া অসম্ভব। প্রত্যাবাসন নিয়ে প্রথমে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত।”
‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’
তবে জান্তার উপ-তথ্যমন্ত্রী জাও মিন তুন রেডিও ফ্রি এশিয়াকে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পরিকল্পনাটি আন্তর্জাতিক আদালতে শুনানির অনেক আগে করা হয়েছে। এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে শান্ত করার চেষ্টার অংশ নয়।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা আগে বলেছিল যে, তারা রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব মেনে নেবে, কিন্তু বাংলাদেশ তাদেরকে ফেরত দিতে অস্বীকার করে।
“আমরা সব সময় বলে আসছি যে আমরা মেনে নেব এবং তাদের আগের মতোই বাঁচতে দেব। তাদের আবাসনও প্রস্তুত করা হয়েছে,” তিনি বলেন।
“এ কথা সত্য যে আমরা তিন-চার বার প্রস্তাব দেওয়ার পরেও তারা ফিরে আসেনি। অন্য পক্ষ তাদের ছেড়ে দেয়নি... তারা রাজনৈতিক এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছে।
রোহিঙ্গা অধিকার কর্মী নে সান লুইন আরএফএকে বলেছেন, “সামরিক বাহিনী বর্তমানে দেশব্যাপী মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করছে। এই অবস্থায় জনজাতিসমূহ তা আশা করতে পারে না জান্তা তাদের অধিকারকে সম্মান করবে।”
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি দেশটির গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করার পর সারাদেশে প্রায় ১৫৮০ জনকে হত্যা করেছে।
“রোহিঙ্গারা ফিরে গেলেও, সম্ভবত তা হাতেগোনা কিছু হবে,” বলেছেন নে সান লুইন। “তাদের বেশিরভাগই বলেছে যে তারা তখনই ফিরে আসবে যদি তারা তাদের প্রাপ্য সম্পূর্ণ মৌলিক অধিকার নিয়ে শান্তিতে বসবাস করতে পারবে।”
প্রতিবেদনটি তৈরি করেছ রেডিও ফ্রি এশিয়ার মিয়ানমার সার্ভিস