আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মিয়ানমারে গণহত্যার তথ্যপ্রমাণ তুলে দিলেন রোহিঙ্গারা
2022.02.28
ঢাকা ও কক্সবাজার

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রধান কৌঁসুলি করিম এ. এ. খান কক্সবাজারে শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের পর রোহিঙ্গা নেতারা বলেছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাঁদের পাশে থাকলে অবশ্যই এ মামলার রায় রোহিঙ্গাদের পক্ষে যাবে। এর জবাবে প্রধান কৌঁসুলি বলেছেন, রোহিঙ্গাদের জীবনের মূল্য রয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধের সঠিক বিচার করা তাঁর অগ্রাধিকারের বিষয়।
আইসিসি কৌঁসুলির এমন ঘোষণার পর ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট শুরু হওয়া রোহিঙ্গা নিধন ও নির্যাতনের জন্য দায়ীদের বিচার হবে বলে আশা করছেন বাংলাদেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনেকেই।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত দুই বছর থমকে থাকার পর আবার তা গতিশীল করতে গত সপ্তাহে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন করিম। তদন্তের অংশ হিসাবে শনিবার তিনি বৈঠক করেছেন রোহিঙ্গাদের সঙ্গে। এরপর রোববার ঢাকায় ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন তিনি।
তাঁর এই সফরের প্রতিক্রিয়ায় আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল ইউনিয়নের উপদেষ্টা মাস্টার মো. ইলিয়াছ সোমবার বেনারকে বলেন, “মামলাটি শুরুর দুই বছর পরে আবার নতুন করে তদন্ত শুরু করেছে আইসিসি। এটি রোহিঙ্গাদের জন্য অবশ্যই ইতিবাচক বিষয়। আমরা বিশ্বাস করি, রোহিঙ্গা নির্যাতনের তদন্তে বেরিয়ে আসবে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে কত নির্দয় গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা নির্যাতন এবং গণহত্যার যত ধরনের ডকুমেন্ট আছে সবকিছুই আমরা আইসিসির কাছে জমা দিয়েছি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হিসেবে আমাদের পাশে থাকলে অবশ্যই এ মামলার রায় রোহিঙ্গাদের পক্ষে আসবে।”
আইসিসি প্রতিনিধি দলের সদস্যদের সঙ্গে অনেক রোহিঙ্গার দেখা হয়েছে জানিয়ে ঘুমধুম নো ম্যানস ল্যান্ডে বসবাসকারী রোহিঙ্গা নেতা দীল মোহাম্মদ সোমবার বেনারকে বলেন, “তাঁরা বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্বাস দিয়েছেন।”
তিনি বলেন, “তাঁদের প্রতি আমাদেরও ভরসা রয়েছে। রোহিঙ্গা গণহত্যার এ মামলায় অবশ্যই ন্যায় বিচারের প্রতিফলন ঘটবে।”
শনিবার রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেন করিম খানের নেতৃত্বে আইসিসি প্রসিকিউশন দল। প্রথমে তাঁরা ক্যাম্প-১৪ এর ক্যাম্প ইনচার্জ -এর কার্যালয়ে আট-দশজন রোহিঙ্গা নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে কয়েকজন আইসিসি লিগ্যাল টিমের সদস্যও ছিলেন।
বৈঠকে থাকা উখিয়ার থাইনখালী রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা খিংমং বেনারকে বলেন, তাঁরা রোহিঙ্গাদের বলেছেন, আইসিসি মামলায় রোহিঙ্গারা যেন ন্যায়বিচার পায় সে লক্ষ্যে তাঁরা কাজ করছেন।
পরে উখিয়ার কুতুপালংয়ে কয়েকটি শিবিরে তাঁরা বিভিন্ন বয়সের রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের সাথে কথা বলেছেন জানিয়ে খিংমং বলেন, “তাঁরা বলেছেন, বিচার পাওয়ার অধিকার রোহিঙ্গাদের আছে এবং তারা বিচার পাবেন।”
রোহিঙ্গা নেতা মো. ছলিম উল্লাহ বেনারকে বলেন “মামলার রায় যদি আমাদের পক্ষে আসে তাহলে আন্তর্জাতিকভাবে চাপে পড়বে মিয়ানমার। এ প্রেক্ষিতে যুগ যুগ ধরে নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার একটা সুযোগ তৈরি হতেও পারে।”
“তবে এজন্য অবশ্যই জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াতে হবে,” বলেন তিনি।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য ভিত্তিক আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন ফ্রন্টের (আরসা) আক্রমণের জবাবে ২০১৭ সালে ২৫ আগস্ট সেদেশের নর্দার্ন রাখাইন স্টেটে বসবাসকারী নিরীহ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর সামরিক অভিযান শুরু করে সেদেশের সেনাবাহিনী ও জঙ্গি বৌদ্ধ গোষ্ঠী।
অস্ত্রের মুখে সেই দফায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গাকে কয়েকদিনের মধ্যে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের কক্সবাজারে ঠেলে দেয়া হয়।
মিয়ানমার আইসিসির মূল দলিল রোম স্ট্যাটুটের এর সদস্য না হলেও আইন বিশ্লেষণ করে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধ তদন্ত করতে ২০১৯ সালের ১৪ নভেম্বর আইসিসির প্রসিকিউটরকে অনুমোদন দেয় আইসিসির প্রি-ট্রায়াল কোর্ট।
তবে মিয়ানমার মনে করে এই তদন্ত করার অধিকার আইসিসির নেই।
এর মধ্যে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বেশ কিছুদিন থমকে যায় এই তদন্ত।
প্রসঙ্গত, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) কোনো দেশের ওপর কোনো অভিযোগের সুরাহা করে থাকে। রোহিঙ্গাদের ওপর ২০১৭ সালে নির্যাতন ও গণহত্যার অভিযোগে গাম্বিয়ার করা মামলার বর্তমানে আইসিজেতে শুনানি চলছে।
অন্য দিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) গণহত্যাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কোনো দেশের ব্যক্তি বিশেষের বিরুদ্ধে অভিযোগের সুরাহা করে থাকে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর মানবতা বিরোধী অভিযোগে সম্পৃক্ত দেশটির বিভিন্ন কর্মকর্তাদের নামে অভিযোগ সম্পর্কে তদন্ত কাজেই বাংলাদেশে এসেছেন করিম খান।
বিচার পাওয়া সম্ভব, বললেন প্রসিকিউটর
রোববার ঢাকায় ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে করিম খান বলেন, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত মানবতা বিরোধী অপরাধ তদন্ত স্তিমিত হয়ে যায়।
এটি তাঁর প্রথম বাংলাদেশ সফর। এর আগে তাঁর পূর্বসূরি ফাতু বেনসুদা বাংলাদেশ সফর করেন।
করিম খান জানান, রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারে সংঘটিত অপরাধের বিষয়ে আইসিসি প্রসিকিউশন দল বাংলাদেশ তদন্ত করছে। এ বছর তাঁরা আবারও বাংলাদেশে আসবেন।
তদন্তে গতি আনতে তিনি তদন্ত দলের তহবিলের পরিমাণ বৃদ্ধি করেছেন বলেও জানান।
বাংলাদেশে সকল প্রকার সহায়তা পেয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বিচার পেতে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করে দেখাতে হবে যে, আন্তর্জাতিক আইন শুধু তত্ত্বকথা নয়, এর মাধ্যমে বিচার পাওয়া সম্ভব।”
বিচার পাওয়ার জন্য প্রসিকিউশনকে আদালতে “অকাট্য প্রমাণ” হাজির করতে হবে বলে জানান করিম খান।
সাজা ও প্রত্যাবাসন ‘দুটি ভিন্ন বিষয়’
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন সোমবার বেনারকে বলেন, সঠিকভাবে মামলা পরিচালিত হলে হয়তো রোহিঙ্গাদের গণহত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের সাজা দেওয়া সম্ভব হবে।
তবে তাঁর মতে, কয়েকজনের “সাজা হওয়াই বড়ো কথা নয়। এর বাস্তবায়নই বড়ো ব্যাপার। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা সাধারণত দেশের বাইরে যান না, তারা দেশেই বসে থাকেন। তাহলে তাদের সাজা বাস্তবায়ন হবে কীভাবে?”
“এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রায়ের মাধ্যমে মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের সাজা দেওয়া হলেই যে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে সেটি আশা করা ঠিক হবে না। কারণ সাজা হওয়া এবং প্রত্যাবাসন দুটি ভিন্ন বিষয়,” বলেন তৌহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, “গত চার-পাঁচ বছরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোনো অগ্রগতি হয়নি। আগামী বছরগুলোতে যে হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। প্রত্যাবাসন একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। মিয়ানমার তার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বদলালেই কেবল রোহিঙ্গারা দেশে ফিরে যেতে পারবে।”