সীমান্তে সেনা মোতায়েন করেছে মিয়ানমার
2018.03.01
ঢাকা ও কক্সবাজার

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মধ্যে হঠাৎ করেই বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্তের ওপারে সৈন্য সংখ্যা বাড়িয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সীমান্তের দেড় শ’ গজের মধ্যে উন্নত প্রযুক্তির ভারী অস্ত্র বাংলাদেশের দিকে তাক করে বসানো হয়েছে। রাতে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) সদস্যরা কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়েছে বলেও জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
এর ফলে শূন্যরেখার আটকে থাকা রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠার পাশাপাশি দু’দেশের সীমান্তেও উত্তেজনা বিরাজ করছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সীমান্তে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিও। বিজিবির পক্ষ থেকে বিজিপিকে পতাকা বৈঠকের বার্তা পাঠানোর পাশাপাশি ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
জানা যায়, তুমব্রুর কোনাপাড়া শরণার্থীশিবির সংলগ্ন কাঁটাতারের বেড়ার কাছে বিজিপি অবস্থান নিয়েছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকার পিলখানার হেডকোয়ার্টারে এক সংবাদ সম্মেলন করেছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস অ্যান্ড ট্রেনিং) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুজিবুর রহমান।
তিনি জানান, মিয়ানমারের অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েনের প্রেক্ষিতে জরুরি পতাকা বৈঠক আহ্বানের পাশাপাশি প্রতিবাদ পাঠিয়েছে বিজিবি। তবে বিজিপির কোনো সাড়া মেলেনি। পরিস্থিতি গভীর পর্যবেক্ষণে রেখে সীমান্তে বিজিবির শক্তিও বৃদ্ধি করা হয়েছে।
বিজিবির হিসাব অনুযায়ী তুমব্রু সীমান্তের জিরো লাইন এলাকায় পাঁচ হাজার ৩৬ জন রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বর্ডার গার্ড পুলিশ বারবার শব্দযন্ত্রের মাধ্যমে তাদের অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য বলছে, যা গত এক মাস ধরেই চলছে।
এ তথ্য জানিয়ে মি. মুজিবুর বলেন, “এটি জোর করে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা।”
সতর্ক অবস্থানে বিজিবি
বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ তুমব্রু সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমার অংশের প্রায় ১৫০ গজ অভ্যন্তরে দেশটি সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছে বলে জানান বিজিবির অতিরিক্ত মহাপরিচালক।
“বেশ কিছু মিলিটারি প্যাটার্নের পিকআপের ট্রাক-লরির মাধ্যমে তারা সেখানে ভারী অস্ত্র স্থাপন করেছে। আমরা সার্ভিল্যান্স ও ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে এসব তথ্য জানতে পেরেছি। এরপর থেকে বিজিবিও সতর্ক অবস্থানে আছে,” বলেন অতিরিক্ত মহাপরিচালক।
মিয়ানমার কী পরিমাণ সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছে তার সঠিক সংখ্যা বলতে না পারলেও বর্ডারে যে পরিমাণ সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছে তা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বলে জানান বিজিবির এই কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, “কী কারণে তারা সৈন্য মোতায়েন করেছে তা জানার জন্যই ফ্ল্যাগ মিটিংয়ের আহ্বান করা হয়েছে। আলোচনায় বসলে বিস্তারিত জানা যাবে। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।”
শূন্যরেখায় অবস্থান করা রোহিঙ্গারা জানান, সকাল থেকে ৭টি ট্রাকে করে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সদস্যরা তুমব্রু সীমান্তের ওপারে কাঁটাতারের বেড়ার কাছে অস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয়। সীমান্তের বেড়া বরাবর বাংকারগুলোতেও অবস্থান নিয়েছে বর্মি সেনারা।
বর্মি সেনাদের সঙ্গে তাদের সীমান্ত রক্ষী পুলিশ (বিজিপি) সদস্যরাও পাহারা দিচ্ছে বলে জানান তাঁরা।
তুমব্রুর শূন্যরেখায় থাকা রোহিঙ্গা নূর মোহাম্মদ বেনারকে জানান, “সকাল থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী মর্টারসহ অন্যান্য অস্ত্র নিয়ে অবস্থান নিয়েছে। তাদের সঙ্গে বিজিপির সদস্যদেরও দেখা যাচ্ছে। এতে করে রোহিঙ্গারা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন।”
তবে এ অবস্থায়ও বিকেল অবধি কোনো রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ঢোকেনি।
রোহিঙ্গা আলী হোসেন ও এমদাদুল্লা জানান, বর্মি সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশের ভূখণ্ডের দিকে অস্ত্র তাক করে রেখেছে। এ ছাড়া, শূন্যরেখায় থাকা রোহিঙ্গাদের দিকেও অস্ত্র ঘুরিয়ে রেখেছে তারা।
যা বলছে গোয়েন্দা প্রতিবেদন
বিজিবি হেডকোয়ার্টারের এক পদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে জানান, তুমব্রুতে বাংলাদেশের দিকে মুখ করে ৬০ মিলিমিটার মর্টার ও মেশিনগান স্থাপন করেছে মিয়ানমার।
ইন্টেলিজেন্সের বরাত দিয়ে তিনি আরও জানান, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ১৪০-১৫০জন সদস্য বিজেপির পোশাক পরে সেখানে অবস্থান নিয়েছে।
তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ‘টিওসি স্পেশাল কমান্ডার’ (কর্নেল) পদে থাকা এক সেনা কর্মকর্তা।
তুমব্রু সীমান্ত থেকে সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, রাত ৮টা ৪০ মিনিটে রোহিঙ্গাদের অবস্থানের কাছে গুলি বর্ষণ করেছে মিয়ানমার। তারা কমপক্ষে ১০ রাউন্ড গুলি ছুড়েছে। আতঙ্কে শূন্যরেখা ছেড়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছে রোহিঙ্গা।
তবে কোনো অবস্থাতেই “শূন্যরেখায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের অনুপ্রবেশের কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না,” বলে বৃহস্পতিবার বান্দরবানে বিজিবির একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
এর আগে সকাল থেকে ১১ বার মাইকিং করেছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। তারা শূন্যরেখা থেকে রোহিঙ্গাদের সরে যাওয়ার জন্য নির্দেশনা দিচ্ছে।
বিজিবি হেডকোয়ার্টারের কর্মকর্তা বেনারকে জানান, মাইকিং-এ বলা হচ্ছে রোহিঙ্গারা যে জায়গায় অবস্থান করছে তা মংডু জেলার অধীন। মিয়ানমারের ওই জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে উল্লেখ করে তাদের সরে যেতে বলা হচ্ছে।
এর আগে দুপুরে বিজিবির কক্সবাজার সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবদুল খালেক বেনারকে বলেন, “ওপারে মিয়ানমার প্রায় সময়ই সেনা সংখ্যা বাড়াচ্ছে। এটি নতুন কিছু নয়। তবে এপারে বিজিবির সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।”
মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব
সীমান্ত উত্তেজনার জেরে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত লুইন উ কে তলব করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বৃহস্পতিবার বিকেলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাঁকে একটি আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদপত্র তুলে দেন ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব এম খোরশেদ আলম।
এর আগে গত ২০ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের ঢেকিবুনিয়া সীমান্তের তংপিও লিতওয়ে এলাকায় দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে সীমান্তে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন প্রসঙ্গে আলোচনা হয়।
তখন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ না করার জন্য আহ্বান জানানো হয়।
“বাংলাদেশ মনে করছে, মিয়ানমার সীমান্তে সামরিক শক্তি বাড়ালে নো-ম্যানস ল্যান্ডে যে রোহিঙ্গারা আছে তারা মিয়ানমারে ফেরত যেতে আগ্রহী হবে না এবং তাদের ফেরত পাঠানোর পুরো প্রক্রিয়াটি অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে,” বেনারকে বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা।
এর আগে মঙ্গলবার তুমব্রু সীমান্ত পরিদর্শন করে রোহিঙ্গাদের মুখে নির্যাতনের বর্ণনা শোনেন তিন নোবেল বিজয়ী নারী। রাখাইনে গণহত্যার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচির বিচারের দাবি তোলেন তাঁরা। তাদের সফরের একদিন পরই মিয়ানমার সরকার সীমান্তে তাদের সৈন্য সংখ্যা বাড়াল।
উল্লেখ্য, গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে এখন অবধি প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তাঁদের অস্থায়ীভাবে আশ্রয় ও মানবিক সহায়তা দিলেও নিজেদের দেশে ফেরত পাঠাতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা আহ্বানসহ দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে বাংলাদেশে সরকার।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি।