প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি দলের ভাসানচর পরিদর্শন, রোহিঙ্গাদের আইনি সহায়তা দেবে ওআইসি

জেসমিন পাপড়ি ও সুনীল বড়ুয়া
2021.03.01
ঢাকা ও কক্সবাজার
প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি দলের ভাসানচর পরিদর্শন, রোহিঙ্গাদের আইনি সহায়তা দেবে ওআইসি ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্পে নিজের ঘরে শিশু সন্তান কোলে এক রোহিঙ্গা নারী। ৩০ ডিসেম্বর ২০২০।
[এএফপি]

আপডেট: ৩ মার্চ ২০২১। ইস্টার্ন সময় সকাল ১১:১০

ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরুর পর প্রথমবারের মতো দ্বীপটি পরিদর্শন করল কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি দল। 

মুসলিম দেশগুলোর জোট ওআইসি’র একটি প্রতিনিধিদল ভাসানচর পরিদর্শনে গিয়ে সেখানে রোহিঙ্গাদের জন্য তৈরি অবকাঠামো ও বিভিন্ন সুবিধা দেখে ‘সন্তোষ’ প্রকাশ করেছে বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়। 

ওআইসির সহকারী মহাসচিব ইউসেফ আলডোবেয়ার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদল রোববার সকালে বঙ্গোপসাগরের দ্বীপ ভাসানচর পরিদর্শন করেন। এর পর তাঁরা ওই দিন বিকেলে উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের সাথে এক মত বিনিময় সভায় মিলিত হন।

“এই প্রকল্পটি চালু হওয়ার পরে আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থার উচ্চ পর্যায়ের কোনো প্রতিনিধি দলের এটাই প্রথম সফর,” বেনারকে বলেন ভাসানচর প্রকল্পের পরিচালক কমোডর এম রাশেদ সাত্তার। 

পরিদর্শনের সময় প্রতিনিধিরা ভাসানচরে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেন জানিয়ে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের মুখে নির্যাতনের কথা, তাঁদের বিভিন্ন দাবি দাওয়ার কথা শুনেছেন ওআইসি প্রতিনিধি দলের সদস্যরা।”

“আমরা আশা করছি, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তাঁদের এ সফর ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে,” বলেন তিনি। 

এর আগে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ভাসানচর পরিদর্শন করেছিলেন জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি। তখনো কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের জন্য দ্বীপটি প্রস্তুত হয়নি।

সংক্ষিপ্ত পরিদর্শন শেষে দ্বীপটিতে আবাসন পরিকল্পনা শুরুর আগে জাতিসংঘকে সেখানে “পূর্ণাঙ্গ কারিগরি, মানবিক ও নিরাপত্তা সমীক্ষা চালাতে অনুমতি দেওয়ার” জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি।

তবে সে ধরনের কোনো সমীক্ষা ছাড়াই এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থাগুলোর আপত্তি উপেক্ষা করে গত ডিসেম্বর থেকে কয়েক দফায় প্রায় দশ হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করেছে সরকার।

এখন পর্যন্ত ভাসানচরে কারিগরি সমীক্ষার অনুমতি পাওয়া যায়নি বলে সোমবার বেনারকে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার এক জাতিসংঘ কর্মকর্তা।

“ভাসানচরে জাতিসংঘের টেকনিক্যাল অ্যাসেসমেন্টের বিষয়ে আমরা এখনো সরকারের অনুমতির অপেক্ষায় আছি,” বলেন তিনি।

এদিকে চলতি সপ্তাহে পঞ্চম দফায় আরো তিন হাজারের মতো রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

মঙ্গলবার দুপুর নাগাদ ওই রোহিঙ্গারা কক্সবাজার থেকে সড়কপথে প্রথমে চট্টগ্রাম ও পরে সেখান থেকে জাহাজে করে ভাসানচর পৌঁছাবেন বলে বেনারকে জানান অতিরিক্ত প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. শামসু দ্দৌজা নয়ন।

আরআরআরসি কার্যালয়ের সূত্রমতে, গত ডিসেম্বর থেকে চার দফায় কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে প্রায় নয় হাজার ৭০০ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়। 

এছাড়া সাগরপথে মালয়েশিয়া যাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশ জলসীমায় ফিরে আসা ৩০৬ জন রোহিঙ্গাকে গত বছরের মে মাসে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে ভাসানচরে নেয়া হয়। তাঁরাও এখনো সেখানে রয়েছেন। 

কক্সবাজারের ঘিঞ্জি শরণার্থী শিবিরগুলো থেকে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য নিজস্ব তহবিল থেকে তিন হাজার ৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। ১৩ হাজার একর আয়তনের ওই চরে এক লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। 

ভাসানচরের পুরো আবাসন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। 

আইনি সহায়তা দেবে ওআইসি

ভাসানচর পরিদর্শন শেষে ওআইসি প্রতিনিধি দলের সদস্যরা রোববার বিকেলে উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন। প্রায় এক ঘণ্টার এই বৈঠকে ৭ নারীসহ ৬৭ জন রোহিঙ্গা নেতা অংশ নেন। 

রোহিঙ্গারা যাতে আত্মমর্যাদা ও সম্মানের সাথে মিয়ানমারে ফিরতে পারেন, সেজন্য আন্তর্জাতিকভাবে ঐকমত্য গড়তে ওআইসি কাজ করছে বলে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানান ওআইসির সহকারী মহাসচিব ইউসেফ আলডোবেয়া। 

“ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) চলমান মামলায় রোহিঙ্গারা যাতে ন্যায় বিচার পান সেজন্য আইনি লড়াইয়ে সহযোগিতা করছে ওআইসি,” বলেন তিনি। 

রোহিঙ্গা ইস্যুতে সব সময় ওআইসি বাংলাদেশের পাশে আছে বলেও জানান তিনি। 

ওআইসির সাথে বৈঠকে নিজেদের ওপর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের কথা তুলেন রোহিঙ্গারা নেতারা। পাশাপাশি নিজেদের বিভিন্ন দাবির কথাও জানান তাঁরা। 

“ওআইসি প্রতিনিধি দল আমাদের বলেছে, রোহিঙ্গাদের সমস্যা সমাধানের জন্য তারা বেশি বেশি চেষ্টা করছেন,” বেনারকে বলেন মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহণকারী রোহিঙ্গা নারী মনোয়ারা বেগম। 

ওআইসির পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল সোমবার ঢাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন ও প্রতিমন্ত্রীর মো. শাহরিয়ার আলমের সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাত করেন। 

সাগরে ভাসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে ভারতের প্রতি আহ্বান 

গত দুই সপ্তাহ ধরে আন্দামান সাগরে একটি নৌকায় ভাসতে থাকা ৮১ জন রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য ভারত সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। 

ওইসব রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দেওয়া ভারতের দায়িত্ব এবং মিয়ানমারের উচিত তাঁদের ফিরিয়ে নেওয়া বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন। 

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত মাস থেকে আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমায় একটি মাছ ধরার নৌকায় ভাসতে থাকা ওই রোহিঙ্গাদের খাদ্য, চিকিৎসা এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা সরবরাহ করে আসছে ভারত। 

এসব রোহিঙ্গা অবৈধ পথে মালয়েশিয়ায় পৌঁছাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পথিমধ্যে তাঁদের নৌকার ইঞ্জিনের ত্রুটি দেখা দেয়। 

নৌযানটিতে থাকা আটজন ইতিমধ্যে মারা গেছেন উল্লেখ করে রয়টার্স জানায়, বেঁচে থাকা ৮১ জনের বেশিরভাগই অসুস্থ এবং তারা তীব্র পানি শূন্যতায় ভুগছেন। 

ভারতের কোস্ট গার্ড ওই রোহিঙ্গাদের সহায়তা দিলেও ভারতের সীমানায় নৌকাটিকে প্রবেশের অনুমতি না দিয়ে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে চাইছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। 

“মানুষগুলোকে (ভাসমান রোহিঙ্গাদেরকে) গ্রহণ করার জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করছি। কীভাবে সমস্ত দেশ আন্তর্জাতিক সমুদ্র সীমায় আটকা পড়া ৮১ জনের জীবনকে অস্বীকার করতে পারে?” বলেন ভারতে রোহিঙ্গা মানবাধিকার উদ্যোগের (আরএইচআরআই) পরিচালক সাব্বের কিয়া মিন। 

“ভারতের উচিত আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে তার দায়িত্ব পালন করা এবং শরণার্থীদের রক্ষা করা,” এক বিবৃতিতে বলেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি। 

রয়টার্স জানিয়েছে, ভাসমান ৮১ জন রোহিঙ্গাকে ভারতে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে কি না—এমন প্রশ্নে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং এটি নিয়ে বাংলাদেশের সাথে আলোচনার বিষয়ে কোনো আপডেটও দেয়নি তারা। 

নয়াদিল্লি ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি, যেখানে বলা হয়েছে যে, শরণার্থীদের অধিকার রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। দেশটির শরণার্থী সুরক্ষা আইন নেই। 

এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বেনারকে বলেন, “সাগরে ভাসমান রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা থেকে ১৭০০ কিলোমিটার, ভারত থেকে ১৪৭ কিলোমিটার এবং মিয়ানমার থেকে ৩৪২ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে।” 

“এ জন্য এসব রোহিঙ্গাকে মানবিক সহায়তা দেওয়া ভারতের দায়িত্ব,” বলেন তিনি। 

মিয়ানমারের সেনাদের অভিযান থেকে প্রাণে বাঁচতে দেশটির রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় শরণার্থী শিবিরগুলোতে বসবাস করছেন। এদের বেশির ভাগই ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নৃশংস অভিযানের সময়ে পালিয়ে এসেছিলেন। 

আরএইচআরআই’র হিসাবে বর্তমানে ভারতে রয়েছেন প্রায় ১৬ হাজারের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থী।

আপডেট: একটি উদ্ধৃতি সংশোধন করা হয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।