টেকনাফে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ একদিনে আট রোহিঙ্গা নিহত
2020.03.02
কক্সবাজার ও ঢাকা

কক্সবাজারের টেকনাফে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) পৃথক ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আট রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন।
র্যাবের অভিযানে সোমবার ভোরে নিহত সাতজনকে ডাকাত এবং প্রায় একই সময়ে বিজিবির অভিযানে নিহত একজনকে মাদক কারবারি দাবি করা হয়েছে।
বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে একদিনে এত বেশি রোহিঙ্গা নিহত হওয়ার ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেনি বলে দাবি করেছেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন।
“বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের শিকার হয়ে একদিনে আটজন রোহিঙ্গার মৃত্যুই এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ,” বেনারকে বলেন নূর খান লিটন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গত নভেম্বরে এক প্রতিবেদনে দাবি করে, বাংলাদেশে ২০১৮ সালের মে থেকে মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেড়েছে।
সেই থেকে সোমবার পর্যন্ত মোট ৭৪ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী এর শিকার হয়েছেন বলে কক্সবাজার জেলা পুলিশের হিসাব সূত্রে জানা গেছে। যার মধ্যে পুলিশের অভিযানে ৩০, বিজিবির অভিযানে ২২ এবং র্যাবের অভিযানে ২২ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন।
গত বছরের ২২ আগস্ট রাতে জাদিমুরাতে স্থানীয় যুবলীগ নেতা ওমর ফারুক (৩০) সশস্ত্র রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হওয়ার পর এই কায়দায় ডাকাত গোষ্ঠীগুলোকে দমনে সক্রিয় হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো।
এক অভিযানেই নিহত সাত
র্যাব কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট মির্জা শাহেদ মাহাতাব সোমবার বেনারকে জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র্যাবের একটি দল জাদিমুরা ও শালবন রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন পাহাড়ে মোহাম্মদ জকির ওরফে জকির ডাকাতের আস্তানার খোঁজে অভিযান চালায়।
“এ সময় ডাকাত দলের সদস্যরা র্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি চালালে র্যাবও পাল্টা গুলি চালায়। এতে সাতজন নিহত হয়েছেন,” বলেন বাহিনীর টেকনাফ ক্যাম্পের এই কোম্পানি কমান্ডার।
নূর খান লিটন বলেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরও বেশি কৌশলী ও সতর্ক হওয়া দরকার। কারণ এই জাতীয় ডাকাত বা দস্যু গ্রুপকে জীবিত অবস্থায় ধরে বিচারের আওতায় আনা গেলে যে বার্তাটি দেওয়া যাবে সেটি ভবিষ্যতের জন্য অনেক ফলদায়ক হবে।”
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা ডাকাতদের একটি গ্রুপ রয়েছে এখানে, জকির গ্রুপ। এই গ্রুপেরই সাতজন র্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে।”
দলের প্রধান জকিরকে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ অভিযান চালাবে জানিয়ে তিনি বলেন, “আশা করছি আজকের মধ্যেই সে গ্রেফতার হবে।”
র্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত সাতজনের মধ্যে তিনজনের নাম জানা গেছে বলে জানান ওসি। এরা হলেন, ফারুক (৩৫), নূর ওরফে নুরাইয়া (৩৫) এবং ইমরান (২২)।
“বাকি চারজনের নাম-ঠিকানাও সংগ্রহের চেষ্টা করছি,” বলেন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ।
এ ঘটনায় র্যাব মামলা করবে বলে জানান তিনি।
থেমে থেমে গুলি বিনিময়
ডাকাত দলের বিরুদ্ধে অভিযানের খবর পেয়ে সোমবার বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছে র্যাব। পাহাড়ের বিভিন্ন স্থান থেকে নিহত রোহিঙ্গাদের লাশ উদ্ধার করছে পুলিশ। আতঙ্কিত চেহারা নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে তাঁদের কর্মকাণ্ড দেখছেন জাদিমুরা ক্যাম্পের শরণার্থীরা।
এমন সময়ে দূরবর্তী একটি পাহাড়ের বনের আড়াল থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিকে গুলি ছোড়া হয়। র্যাবকেও পাল্টা গুলি ছুড়ে জবাব দিতে দেখা যায়। এরপর থেকেই থেমে থেমে গুলি বিনিময় চলছিল।
পাশেরই শালবন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি-ব্লকের রাজুমা বেগম (৩৫) ভয়ে সকাল থেকে কিছু খাননি। বেনারকে তিনি বলেন, “গোলাগুলির শব্দে রাত তিনটার দিকে আমার ঘুম ভেঙে যায়। সকাল নয়টা পর্যন্ত অনেক গোলাগুলি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল বাইরে ভূমিকম্প হচ্ছে। গুলির শব্দে ছেলে-মেয়েরাও ভয় পেয়ে অনেক কান্নাকাটি করেছে।”
একই ক্যাম্পের বৃদ্ধ রোহিঙ্গা হাফেজ আহমদ বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের জলুমকারিদের মৃত্যুর খবর শুনে আমরা সবাই খুশি। তবে ভয়েও আছি। কেননা এখনো বড় ডাকাত জকির ধরা পড়েনি। না জানি সে ফিরে এসে ক্যাম্পের মানুষদের ওপর আবার কী অত্যাচার চালায়।”
“এই ক্যাম্পে প্রতি রাতে গুলির শব্দ শোনা যায়। ফলে ভয়ে প্রতিদিন নির্ঘুম রাত কাটে আমাদের,” বলেন তিনি।
রোহিঙ্গা নারী খতিজা বেগমও বেনারকে বলেন, “ক্যাম্পের লোকজন সারা রাত গুলির আওয়াজ পেয়ে আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে।”
র্যাব-১৫ এর অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম উদ্দিন আহমেদ জানান, ঘটনাস্থল থেকে তিনটি বিদেশি পিস্তল, ১২ রাউন্ড গুলি এবং সাতটি এলজি উদ্ধার করেছেন তাঁরা।
বিজিবির ‘বন্দুকযুদ্ধ’
টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের নয়াপাড়া জাদিখাল এলাকায় বন্দুকযুদ্ধে রোববার দিবাগত রাতে রোহিঙ্গা মাদক পাচারকারী নুর আলম (৩০) নিহত হওয়ার পর ঘটনাস্থলে তল্লাশি চালিয়ে দেড় লাখ ইয়াবা, একটি দেশীয় বন্দুক ও দুই রাউন্ড তাজা কার্তুজ উদ্ধার করা হয়।
বিজিবির টেকনাফ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল ফয়সল হাসান খান বেনারকে জানান, ইয়াবার একটি বড় চালান বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে এমন সংবাদে টেকনাফ ব্যাটালিয়নের বিশেষ টহলদল নোয়াপাড়া অবস্থান নিয়ে দুই-তিন ব্যক্তিকে নৌকা নিয়ে নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেখে।
“তাদের চ্যালেঞ্জ করলে নৌকায় থাকা ব্যক্তিরা লাফ দিয়ে খালের অপর পাশে নেমে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ধাওয়া করলে তারা বিজিবিকে লক্ষ্য করে গুলি করে। বিজিবিও পাল্টা গুলি চালায়,” বলেন তিনি।
ঘটনাস্থল থেকে পরবর্তীতে নুর আলমের লাশ উদ্ধার করা হয় বলে জানান ফয়সল হাসান খান।