রোহিঙ্গা সংকট: এ বছর ব্যয় হবে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা

কামরান রেজা চৌধুরী ও সুনীল বড়ুয়া
2020.03.03
ঢাকা ও কক্সবাজার
200303_JRP-UNHCR_1000.jpg উখিয়ার লম্বাশিয়া শরণার্থী শিবিরে একটি দোকানের সামনে বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন এক রোহিঙ্গা। ৯ ডিসেম্বর ২০১৯।
[সুনীল বড়ুয়া/বেনারনিউজ]

বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গা এবং তাঁদের আশ্রয়দাতা স্থানীয় জনগণের সহায়তার জন্য এ বছর খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় সাত হাজার ৪৩২ কোটি টাকার বেশি।

মঙ্গলবার জেনেভা থেকে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এবং সহযোগী এনজিওরা রোহিঙ্গা সম্পর্কিত মানবিক সংকট মোকাবেলায় ২০২০ সালের যৌথ কর্ম পরিকল্পনা (জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান-জেআরপি) ঘোষণা করে বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে এই অর্থ চেয়েছে।

বাংলাদেশে অবস্থানকারী আট লাখ ৫৫ হাজার রোহিঙ্গা এবং চার লাখ ৪৪ হাজার স্থানীয় জনগণকে সহায়তা দেবার জন্য এই অর্থ চাওয়া হয়েছে।

২০১৭ সালে ২৫ আগস্ট থেকে দলে দলে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের পর থেকে প্রতিবছর রোহিঙ্গাদের জন্য প্রয়োজনীয় খরচ নির্ধারণ করে সাহায্যের আবেদন জানায় জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এবং সহযোগী এনজিওরা।

২০১৯ সালের জেআরপিতে রোহিঙ্গাদের জন্য ৯২১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তহবিলের আবেদন করা হয়েছিল। তার মধ্যে বিভিন্ন দেশ ও দাতা সংস্থা থেকে পাওয়া গিয়েছিল মোট প্রয়োজনের শতকরা ৭০ ভাগ অর্থাৎ ৬৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল সর্বোচ্চ সাহায্য প্রদানকারী দেশ।

জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর মঙ্গলবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, “সামগ্রিকভাবে মোট অর্থের প্রায় ৫৫ শতাংশ প্রয়োজন হবে খাদ্য, আশ্রয়, নিরাপদ পানি এবং স্যানিটেশনসহ প্রয়োজনীয় জরুরি সেবার জন্য। আর শুধু খাদ্যনিরাপত্তার জন্য মোট তহবিলের প্রায় ২৯ শতাংশ ব্যয় হবে।”

আরও বলা হয়, “এ ছাড়া স্থানীয় বাংলাদেশিদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য, সুরক্ষা, শিক্ষা, ক্যাম্প ব্যবস্থাপনা, জ্বালানি এবং পরিবেশ সংক্রান্ত কার্যক্রমগুলো অব্যাহত রাখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।”

ইউএনএইচসিআর-এর হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যাণ্ডি বলেন, “যত দিন পর্যন্ত রোহিঙ্গারা নিজেদের দেশে স্বেচ্ছায় ফিরে না যাবে, তত দিন পর্যন্ত অবশ্যই বিশ্ববাসীকে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি তাঁদের আশ্রয়দাতা বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের পাশে থাকতে হবে।”

পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিক নয়, তারা অতিথি। সরকার তাঁদের জোর করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাবে না।

তিনি বলেন, “আমরা আশা রাখি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তারা মিয়ানমার ফিরে যাবে।”

বিপাকে স্থানীয়রা

রোহিঙ্গা সংকট তিন বছরে পদার্পণে এবং তাঁদের প্রত্যাবাসনে কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় ক্ষোভ বেড়েছে স্থানীয়দের। তাঁরা চান যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গারা নিজেদের দেশে ফিরে যাক।

রোহিঙ্গা বিরোধী সংগঠন কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. আয়াছুর রহমান বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের সরকার আশ্রয় দিয়েছে। তাঁদের মানবিক দিকগুলো আমাদের অবশ্যই দেখতে হবে। কিন্তু তাঁদের আশ্রয় দিতে গিয়ে আমরা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনধারণ যে মানবেতর হয়ে যাচ্ছে।”

তিনি বলেন, “রোহিঙ্গারা যত দিন বাংলাদেশে আছে তত দিন তাঁদের ভালোভাবে রাখার জন্য যেমন পরিকল্পনা দরকার পাশাপাশি তাঁদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার জন্যও সুষ্ঠু পরিকল্পনা দরকার।

“কিন্তু বরাবরই দেখা যায় তাঁদের মানবিক সহায়তার বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘ যতটা তৎপর, প্রত্যাবাসন এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সমস্যা নিয়ে তারা ততটা আন্তরিক মনে হয় না,” বলেন তিনি।

রোহিঙ্গা রিফিউজি কমিটি সভাপতি ও উখিয়ার ক্যাম্প-২ এর চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল মোস্তফা বেনারকে বলেন, “আমরা এখানে থাকতে চাই না। এটি আমাদের দেশ নয়। আমরা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই। তবে আমাদের সব অধিকার নিয়ে।”

উখিয়ার কুতুপালং দুই নম্বর ক্যাম্প ইস্ট জোনের এর চেয়ারম্যান মো. নূর বলেন, “মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে আমরা এখানে আশ্রয় নিয়েছি। অনেক বছর হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা বরাবরই দেখছি মিয়ানমার সরকার আমাদের ফিরিয়ে নিতে আন্তরিক নয়। এ অবস্থায় আমরা অসহায়।”

তিনি বলেন, “মিয়ানমার যদি আমাদের সকল অধিকার ফিরিয়ে না দেয় তাহলে আমরা কোথায় যাব?”

বাংলাদেশে এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির বেনারকে বলেন, “আসলে রোহিঙ্গা একটি আন্তর্জাতিক সংকট; এটি আমাদের ঘাড়ে এসেছে। একটি আন্তর্জাতিক সংকটের বোঝা আমাদের বইতে হচ্ছে।”

তিনি বলেন, “যেহেতু এটি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা সেহেতু রোহিঙ্গাদের ভরণপোষণের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটি ভূমিকা আছে। আবার তাঁদের আশ্রয় দিতে গিয়ে আমাদের স্থানীয় জনগণ যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের স্বার্থ দেখার দায়িত্বও আছে তাদের।”

রাষ্ট্রদূত বলেন, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের ভরণপোষণ করছে। এটি একটি সাময়িক ব্যবস্থা। তবে আমি মনে করি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত মিয়ানমারকে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা যাতে তারা রাখাইনে নিরাপদে, স্বেচ্ছায় এবং সম্মানের সাথে সেখানে ফিরে যেতে পারে।”

সেভ দ্যা চিলড্রেনের বিবৃতি

জেআরপি ঘোষণার পর রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য বিশেষ আবেদন জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে সেভ দ্যা চিলড্রেন।

বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে পাঁচ লক্ষাধিক শিশু বসবাস করে। মিয়ানমারে সংগঠিত মানবাধিকার লঙ্ঘন, ভয়াবহ সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ড স্বচক্ষে দেখা ও প্রাণভয়ে পালিয়ে আসায় এসব রোহিঙ্গা শিশুদের জীবন থমকে গেছে। তারা বিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষা ও নিরাপদ পরিবেশে খেলাধুলার অধিকার ও সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসার তিন বছর পূর্ণ হতে চলেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এই সব রোহিঙ্গা শিশুরা যাতে শরণার্থী শিবিরের বাইরে তাদের ভবিষ্যৎ খুঁজে পায় তার ব্যবস্থা করা।

বিৃবতিতে বলা হয়, সেভ দ্য চিলড্রেন আশা করে যে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারের ওপর দ্বিগুণ চাপ প্রয়োগ করবে যাতে তারা রোহিঙ্গাদের স্বতঃস্ফূর্ত ও নিরাপদ প্রত্যাবাসনের পরিবেশ নিশ্চিত করে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।