মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান: বিক্ষোভকারীদের ওপর চলমান নিপীড়ন রোহিঙ্গাদের কাছে ‘সেনাবাহিনীর পরিচিত চরিত্র’

জেসমিন পাপড়ি, আবদুর রহমান ও শৈলজা নীলাকান্তন
2021.03.05
কক্সবাজার, ঢাকা ও ওয়াশিংটন ডিসি
মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান: বিক্ষোভকারীদের ওপর চলমান নিপীড়ন রোহিঙ্গাদের কাছে ‘সেনাবাহিনীর পরিচিত চরিত্র’ বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সীমান্তের শূন্য রেখায় কাঁটাতারের বেড়ার পেছনে জড়ো হওয়া কিছু রোহিঙ্গা শরণার্থী। ২৫ এপ্রিল ২০১৮।
[এএফপি]

মিয়ানমারে নাগরিকদের ওপর সেনাবাহিনীর বর্তমান দমন-নিপীড়নকে রোহিঙ্গাদের উপর সংঘটিত বর্বরোচিত অত্যাচারেরই প্রতিফলন বলে মনে করছেন বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীরা।

তরুণ বার্মিজদের অনেকেই এখন রোহিঙ্গাদের উপর নৃশংসতার সময় নিজেদের নীরবতার জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করেছেন। এই সংহতির জেরে মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য তৈরি হলে দেশটি থেকে সামরিক শাসন চিরতরে বিতাড়িত হবে বলে ধারণা করছেন অনেকেই। 

রাখাইনে নিরাপত্তা চৌকিতে একটি সশস্ত্র রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর আক্রমণের জবাবে ২০১৭’র আগস্ট মাসে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে শুরু করে নৃশংস অভিযান। এর ফলে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেন।

ওই সময় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে অন্তত ২৪ হাজার ৮০০ রোহিঙ্গা নিহত ও সাড়ে ১৮ হাজার রোহিঙ্গা নারী ও কিশোরী ধর্ষণের শিকার হন বলে ২০১৮ সালের আগস্টে এক গবেষণায় জানায় ওন্টারিও ইন্টারন্যাশনাল ডেভলেপমেন্ট এজেন্সি। 

ওই ঘটনার সাড়ে তিন বছর পর, এখন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও পুলিশ দেশটির জাতিগত সংখ্যাগরিষ্ঠদের ওপর তাক করে আছে নিজেদের অস্ত্র। অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হটানোর প্রতিবাদে রাস্তায় নামা সাধারণ মানুষের ওপর চালানো হচ্ছে গুলি। 

জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তর জানিয়েছে, গত ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পর থেকে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে কমপক্ষে ৫৪ জন নিহত হয়েছেন। 

রোহিঙ্গা গণহত্যার সময় তারা কোথায় ছিল?

কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির কেন্দ্রিক রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান ছৈয়দ উল্লাহ প্রশ্ন করেন, “মিয়ানমারে যারা এখন আন্দোলন করছে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা গণহত্যার সময় তারা কোথায় ছিল?”

“সে সময় রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো বর্বরতা বন্ধের আন্দোলনে সবাই যদি একজোট হয়ে নামত, তাহলে আজকের এই আন্দোলন করতে হতো না,” বলেন ছৈয়দ উল্লাহ।

তাঁর মতে, “যারা রোহিঙ্গাদের পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে তাদের একমাত্র ভালো বলা যাবে।” 

মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান বিরোধীদের সাথে সংহতি প্রকাশ করে ছৈয়দ উল্লাহ বলেন, “সেখানে (মিয়ানমারে) থাকলে আমরাও এই প্রতিবাদে সামিল হতাম।” 

ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর ৭৩ বছরের বেশিরভাগ সময় মিয়ানমারকে শাসন করেছে সামরিক বাহিনী। ২০১৭’র আগস্ট বা তার পরবর্তী সময়ে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের উপর যা ঘটেছিল তা মূলত রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সেনাবাহিনী দ্বারা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর উপর বহু দশকের বৈষম্য এবং নির্যাতনের ধারাবাহিকতা।

সাংবিধানিকভাবে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। বরং বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী বিদেশি হিসেবে গণ্য করে থাকে। 

সেনাবাহিনীর অত্যাচার ও নিপীড়ন কী জিনিস রোহিঙ্গাদের তা ভালোভাবেই জানা আছে বলে জানান টেকনাফের লেদা নতুন রোহিঙ্গা শিবিরের হেড মাঝি মোস্তফা কামাল।

তিনি বলেন “যে সময় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা চলছিল তখন যদি তারা (রাখাইন বৌদ্ধরা) প্রতিবাদ করত, তাহলে দেশটিতে বর্তমান পরিস্থিতি দেখতে হতো না।”

“এখন যখন নিজেদের উপর অত্যাচারের খড়গ এসেছে, তখন তারা পথে নেমেছে। অথচ সেসময় এই সেনাবাহিনীকেই সমর্থন করেছিল এরা,” বলেন মোস্তফা কামাল।

“যারা অপরাধ দেখে চুপ থাকে, তারাও অপরাধী। এটি চুপ থাকার ফল। মিয়ানমার সেনাবাহিনী কখনো মানুষের ভালো চায়নি, সেটি আগে থেকেই বলে আসছিলাম আমরা,” বলেন এই রোহিঙ্গা নেতা। 

তবে মিয়ানমারের নাগরিকদের বর্তমান দুর্দশায় কামাল বা ছৈয়দ উল্লাহরা কেউ উল্লাস করছেন না। বরং সেনাবাহিনীর আসল রূপ সম্পর্কে মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠদের বোধোদয় হওয়ায় তাঁরা খুশি। 

তাঁরা জানান, রোহিঙ্গারা সেনাশাসনের প্রতিবাদকারীদের পক্ষে আছেন এবং জেনারেল মিন অং লাইয়ের নেতৃত্বে সেনা অভ্যুত্থানের প্রবলভাবে বিরোধী।

“রাখাইনরা আমাদের ওপর নিপীড়নের কোনো প্রতিবাদ না করলেও তাদের উপর সেনাবাহিনীর এই নির্যাতনের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি আমরা রোহিঙ্গারা,” বলেন মোস্তফা কামাল। 

প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরের আরেক রোহিঙ্গা নেতা টেকনাফ উনচিপ্রাং ক্যাম্পের হেড মাঝি মোহাম্মদ ইউছুপ।

“আমরা চাই মিয়ানমারের সকল মানুষ যেন নিজের অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারে। আর অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন ছাড়া বিকল্প নেই,” বলেন তিনি। 

সেনা অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে রোহিঙ্গা

মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশেও বিক্ষোভ করছেন রোহিঙ্গারা। সবকিছুর পরও অং সান সু চির প্রতি তাঁদের সহানুভূতি রয়েছে।

২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের উপর জাতিগত নির্মূল অভিযান চালানোর সময় মিয়ানমারে শীর্ষ নেতৃত্বে ছিলেন সু চি। সামরিক অভিযানের সময় তাঁর নিষ্ক্রিয়তার জন্য শুধু রোহিঙ্গারা নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও তাঁর সমালোচনা করেছিল। 

সেনা অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে বাংলাদেশের শরণার্থীদের ছবি নিয়মিত পোস্ট করে আসছে ‘রোহিঙ্গা ফটোগ্রাফি’ হিসেবে পরিচয় দানকারী ‘মোঃ জামাল ফটোগ্রাফি’ নামের একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট। 

বৃহস্পতিবার ঐ অ্যাকাউন্টে মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গা নারীদের প্রতিবাদের একটি ছবি পোস্ট করা হয়।

ছবিটিতে বলা হয়, “আমরা বার্মায় সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই এবং আমরা বার্মার সমস্ত জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর জন্য প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকার চাই।” 

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা সংখ্যালঘু বার্মিজ নারীদের প্রতিনিধিত্বকারী রোহিঙ্গা নারী নেটওয়ার্কের এক বিবৃতিতে বলা হয়, “সামরিক অভ্যুত্থান হলো মিয়ানমারের জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা।” 

গত ১১ ফেব্রুয়ারির ঐ বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা মিয়ানমারের জনগণের সাথে সংহতি জানাচ্ছি।”

নিক্কেই এশিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের ভেতরেও রোহিঙ্গা এবং অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুরা সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে দেশটির জাতিগত সংখ্যাগরিষ্ঠ বিক্ষোভকারীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। 

জাতিগত কারেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত ২৫ বছর বয়সী এক বার্মিজ জনসংযোগ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে নিক্কেই এশিয়া বলেছে, “আমি মিয়ানমারের জনগণকে এত সুদৃঢ় ঐক্যে কখনও দেখিনি।”

“এটি কেবল ইয়াঙ্গুনেই নয়, পুরো মিয়ানমার জুড়েই রয়েছে। আমরা ন্যায়বিচার, সত্য এবং গণতন্ত্রের জন্য একসাথে লড়াই করব,” বলেন তিনি। 

‘আমি সত্যিই দুঃখিত’

ধীরে হলেও এখন মিয়ানমারের নাগরিকরা বুঝতে পারছেন রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়ে তাঁদের নীরবতা কতটা ভয়াবহ ছিল।

মিয়ানমারে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে একদল তরুণ নিরীহ রোহিঙ্গাদের হত্যার বিষয়ে অনুশোচনাসূচক প্ল্যাকার্ড বহন করেছেন।

টুইটারে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া একটি ছবিতে দেখা যায় একজন বর্মিজ তরুণ একটি স্মারক চিহ্নে লিখেছেন, “মিয়ানমার সেনাবাহিনী যে রোহিঙ্গা সংকট তৈরি করেছে তার জন্য আমি সত্যিই মর্মাহত।”

ভাইস নিউজের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্মণ মোবাইল প্রযুক্তির একজন ডেভেলপার গত মাসে বেশ কয়েকটি টুইট লেখেন। বিগত নির্বাচনে একজন রোহিঙ্গা প্রার্থীকে ‘বাঙালি’ হিসেবে চিহ্নিত করে একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরির কাজে জড়িত থাকায় তিনি ক্ষমা চেয়েছেন। 

“আমি জানি এই কথাগুলো বলতে দেরি হয়ে গেছে। তবুও যে পীড়া আমাকে তাড়া করে ফিরছে তা স্বীকার করতে হবে। গত অক্টোবরে আমি কয়েকজন বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে একটি অ্যাপ তৈরি করেছিলাম, যে অ্যাপটিকে জাস্টিস মিয়ানমারের পক্ষ থেকে “রোহিঙ্গাদের প্রতি বর্ণবাদী” হিসেবে সমালোচনা করা হয়েছিল,” টুইট করেন তিনি।

“সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় আমার জ্ঞানচক্ষু খুলে দিয়েছে। আমি বুঝতে শুরু করেছি সেই সময়ে আমার নীরবতা আমাকে রোহিঙ্গাদের গণহত্যায় সম্পৃক্ত করেছিল। সেসময় নীরব থাকায় আজ আমি সত্যই দুঃখিত,” টুইটে বলেন তিনি। 

অভিন্ন স্বার্থে ঐক্যের তাগিদ

অনেক রোহিঙ্গা এই অগ্রগতিকে স্বাগত জানিয়েছেন। রোহিঙ্গা অধিকার কর্মী আলী জিন্নাহ হুসেন, টুইটারে বলেছেন, তরুণ বার্মিজরা অনুশোচনা প্রকাশ করায় তাঁর হৃদয় গলে গেছে।

“একজন রোহিঙ্গা হিসেবে আমি এই দেখে খুশি যে, এই প্রজন্ম বাস্তবতা বুঝতে পারছে এবং সত্যকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত। আমি তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ এবং আশা করি আরও মানুষ তাদের অনুগামী হবে,” টুইট করেন তিনি। 

এই অগ্রগতি অবশ্যই মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্তির এক পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক সংসদ সদস্য এবং “মিয়ানমারের রোহিঙ্গা গণহত্যা: পরিচয়, ইতিহাস এবং বিদ্বেষ বচন” গ্রন্থের লেখক রোনান লি। 

“এই অভ্যুত্থান এবং তার পরবর্তী পরিস্থিতি মিয়ানমারের রাজনীতি থেকে স্থায়ীভাবে সেনা প্রভাব নিরসনে এবং সাংবিধানিক কাঠামোর সংস্কারের অভিন্ন স্বার্থে রোহিঙ্গা ও মিয়ানমারের তরুণদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে,” অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রবন্ধে লিখেছেন লি।

“গণতন্ত্রের মূল্য এবং সামরিক শাসনের বিপদ রোহিঙ্গারা ভালো জানেন। আন্তর্জাতিক সমর্থন জোরদার করার বিষয়টি বিবেচনায় নিলে রোহিঙ্গাদের এখন সেনাবাহিনীকে ক্ষমতাচ্যুত করার অভিযানে গণতন্ত্রের প্রতিবাদকারীদের অন্যতম মিত্র হওয়া উচিত। রোহিঙ্গা ও অন্যদের জন্য সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো সহযোগিতা,” বলেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।