রোহিঙ্গা শরণার্থী: জাতিসংঘ ও বাংলাদেশের প্রত্যাশিত অনুদানে সাড়া বেশ কম
2023.03.07
ঢাকা

দশ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং কক্সবাজার জেলার প্রায় পাঁচ লাখ স্থানীয় বাসিন্দাকে সহায়তা করতে জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ৮৭ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি (৮৭৬ মিলিয়ন) সহায়তা চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই চাহিদার বিপরীতে অনুদান মিলেছে খুবই কম।
ফলে আগামী এক বছর শরণার্থীদের খাদ্য ও পানি, বাসস্থান ও চিকিৎসা সেবাসহ জরুরি প্রয়োজন মেটাতে হিমসিম খাবে দাতা সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকার।
জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান (জেআরপি) হিসাবে পরিচিত এই তহবিলে সবচেয়ে বড়ো দাতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার আগামী বছরের জন্য ২৬ মিলিয়ন ডলার সহায়তা ঘোষণা করেছে।
নতুন এই সহায়তা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে অবস্থানকারী শরণার্থী ও স্থানীয় জনগণের জন্য খরচ করা হবে বলে মঙ্গলবার জেনেভায় ঘোষণা দেন মার্কিন সরকারের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলিয়েটা ভলস নয়েস।
গত বছর যুক্তরাষ্ট্র সরকার ১৫২ মিলিয়ন ডলার দিয়েছিল। সেই হিসেবে, গত বছরের চেয়ে ১২৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার কম সহায়তা ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
এ বছরের ঘোষণাসহ ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা শরণার্থী আসার পর থেকে এই তহবিলে মার্কিন সরকারের অনুদান এক দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার।
আরেক দাতা দেশ যুক্তরাজ্য সুনির্দিষ্ট কোনো অঙ্কের অনুদান ঘোষণা করেনি। তবে দেশটি বলেছে, তারা রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা প্রদান করে যাবে। ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ব্রিটেনের সহায়তার পরিমাণ ৪৩৫ মিলিয়ন পাউন্ড।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তহবিল সংগ্রহের জন্য বর্তমানে জেনেভা রয়েছেন।
‘সংকট দিন দিন বাড়ছে’
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে দাতা দেশগুলো অর্থনৈতিক চাপে রয়েছে এবং এ বছর বড়ো অঙ্কের সহায়তা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
২০২২ সালের মার্চ মাসে এক বছরের জন্য জেআরপি তহবিলে ৮৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সহায়তা চাওয়া হলেও এর বিপরীতে অনুদান মিলেছিল ৫৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যা মোট চাহিদার প্রায় ৬৩ ভাগ।
ক্রমাগত সহায়তা কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে গত মাসে জাতিসংঘ খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) রোহিঙ্গাদের জন্য প্রতি মাসে জনপ্রতি বরাদ্দ ১২ মার্কিন ডলার থেকে কমিয়ে ১০ ডলারে নামিয়ে এনেছে।
জাতিসংঘের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছেন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। তাঁদের বক্তব্য, আর্থিক বরাদ্দ কমানো হলে রোহিঙ্গাদের অপুষ্টি বেড়ে যাবে এবং শিবিরে সহিংসতা বৃদ্ধি পাবে। মাদক ও মানবপাচার বেড়ে যাবে।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস এর নেতা মাস্টার শফি উল্লাহ বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার ছয় বছর হয়ে গেছে। কিন্তু প্রতিবছরই আমাদের খাদ্য সংকট দিন দিন বাড়ছে।”
তিনি বলেন, “ডব্লিউএফপি প্রতি মাসে যে খাদ্য সহায়তা দেয় তা এমনিতেই আমাদের জন্য পর্যাপ্ত নয়। এর মধ্যে মার্চ থেকে দুই ডলার কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা নিয়ে আমরা খুব দুশ্চিন্তায় আছি।”
শফি উল্লাহ বলেন, প্রায় প্রতিবছর রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে আসছে, ফলে দিন দিন সংকট বাড়ছে।
তিনি বলেন, “সন্তানদের পড়ালেখাসহ তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে বুঝতে পারছি না। আমরা সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত।”
উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্প-৯ এর হেডমাঝি আব্দুল আমিন বেনারকে বলেন, “এক বেলার জন্য শাক কিনতেও আমাদের ২০-২৫ টাকা লাগে। এক হাজার টাকা দিয়ে একজন মানুষ কীভাবে চলবে?”
তিনি বলেন, “এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আকুল আবেদন, আপনারা রোহিঙ্গাদের জীবন বাঁচাতে সহায়তা করেন।”
আব্দুল আমিন বলেন, “দিন দিন রোহিঙ্গাদের সংসার দিন বড়ো হচ্ছে। সব কিছুর চাহিদা বাড়ছে। এ অবস্থায় সহায়তা যদি আরও কমে যায়, তাহলে দেখা যাবে ক্যাম্পগুলোতে অপরাধ কর্মকাণ্ড বেড়ে যাবে। লোকজন পাচারের শিকার হবে।”
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট নিষ্ঠুর সামরিক অভিযানের মাধ্যমে মিয়ানমারের নর্দার্ন রাখাইন স্টেট থেকে সাড়ে সাত লাখের বেশি সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানকে দেশছাড়া করে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী এবং উগ্র বৌদ্ধ গোষ্ঠী।
প্রাণভয়ে বাংলাদেশে চলে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ছিল সাড়ে সাত লাখের বেশি।
নিজ দেশের রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে বাংলাদেশের সাথে প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষর করে সে দেশের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত অং সান সূ চি সরকার। তবে সূ চি সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে কাজ করেনি।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন সূ চি। এরপর সামরিক সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি।
এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাও নিজ দেশে ফেরত নেয়নি মিয়ানমার সরকার।
বর্তমানে মিয়ানমারে সেনা সরকারের সাথে সূ চি সরকারের সমর্থকরা সশস্ত্র যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।
রোহিঙ্গা শরণার্থীরা কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করছেন।
১৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় দেয়া কার্যপত্রে বলা হয়েছে, প্রতিদিন রোহিঙ্গা শিবিরে ৯৫ জন শিশু জন্মগ্রহণ করছে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা হবে ১৩ থেকে ১৪ লাখ।
‘রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আন্তর্জাতিক আগ্রহ কমে যাচ্ছে’
সাবেক রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশি ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের চেয়ারম্যান মুনশি ফায়েজ আহমাদ মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “দেখুন, এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। প্রতি বছর আন্তর্জাতিক সাহায্য কমে আসছে।”
তিনি বলেন, এই সাহায্য কমে যাওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারি বিশ্বের সব দেশের জন্য একটি বিরাট ধাক্কা। ওই মহামারির পরই শুরু হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।
মুনশি ফায়েজ বলেন, “এই যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বের অর্থনীতি খারাপ অবস্থায় রয়েছে। এমনকি দাতা দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যও ভালো অবস্থায় নেই। এই টালমাটাল অবস্থার মধ্যে দাতারা যে অর্থ প্রদান করছেন সেটি যথেষ্ট নয়। তবে তাঁরা যদি অর্থ না দেয়, তাহলে সেই টাকা বাংলাদেশকে খরচ করতে হবে।”
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের বসিয়ে বসিয়ে না খাইয়ে এই সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান করতে হবে। এই সমাধান হবে কেবলমাত্র স্বেচ্ছায়, নিরাপদে এবং মর্যাদার সাথে তাঁদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে।
মুনশি ফায়েজ আহমাদ বলেন, “এই সংকট সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া মানবতা বিরোধী অপরাধের যে বিচার চলছে সেটিকে ত্বরান্বিত করতে বাংলাদেশের সম্ভাব্য সবরকম সহায়তা করা উচিত। এই বিচারের রায় রোহিঙ্গাদের পক্ষে গেলে মিয়ানমার জান্তা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত হতে পারে।”
তিনি বলেন, “এ ছাড়া, মিয়ানমারে যে গৃহযুদ্ধ চলছে সেটি সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এক সাথে কাজ করা উচিত। গৃহযুদ্ধ বন্ধ হলে রোহিঙ্গারা ফেরত যেতে পারবে। এবং মিয়ানমারে যাদের বিনিয়োগ রয়েছে তারাও লাভবান হবে।”
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে সুনীল বড়ুয়া।