মিয়ানমার সীমান্তে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি, সতর্ক বাংলাদেশ
2018.03.09
ঢাকা ও কক্সবাজার

দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে গত ২ মার্চ পতাকা বৈঠকের পর উত্তেজনা কিছুটা কমলেও উভয়পক্ষ আগের স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরে যায়নি। মিয়ানমার সীমান্তে বিজিপির পাশাপাশি সেনা মোতায়েন বহাল রেখেছে।
এছাড়া সীমান্তের জিরো পয়েন্টে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে চলে যাওয়ার জন্য হুমকি ও চাপ অব্যহত রেখেছে মিয়ানমার।
বান্দরবান জেলার তুমব্রু সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমারের সেনা সমাবেশের জবাবে বাড়তি সদস্য মোতায়েন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
শূন্যরেখার কাছাকাছি সেনা সমাবেশকে মিয়ানমারের ‘উস্কানি’ বলে মনে করলেও “কোনও ফাঁদে” পা না দিয়ে কূটনৈতিকভাবেই বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চায় বলে জানান তিনি।
“তবে উস্কানির জবাবে আমরা নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে অতিরিক্ত বিজিবি মোতায়েন করেছি,” শুক্রবার নিজ বাসায় বেনারকে বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
বিজিবির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বেনারকে জানান, তারা (বিজিবি) নিজেরা গুলি ছুড়বে না। তবে আক্রান্ত হলে সমুচিত জবাব দেওয়া হবে।
এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিত্তেতে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা এবং সীমান্তে রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) উপস্থিতির সংবাদের প্রেক্ষিতেই সৈন্যসংখ্যা বাড়ানো হয়েছে বলে গত সপ্তায় বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়াকে জানিয়েছিলেন মিয়ানমার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সেক্রেটারি উ মিন্ট থু।
“সাম্প্রতিক সময়ে সিত্তেতে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে, এবং জানা গেছে যে আরসা সন্ত্রাসীরা দুই দেশের সীমান্ত এলাকায় লোকজনের ভীড়ে মিশে অবস্থান করছে। এই তথ্যের ভিত্তিতে আমরা নিরাপত্তা বাড়িয়েছি,” বলেন উ মিন্ট থু।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের সেনা অভিযানের মুখে রাখাইনের প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাঁদের ফেরত নেওয়ার আলোচনার মাঝেই গত ১ মার্চ মিয়ানমার হঠাৎ তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখার কাছাকাছি বাড়তি সেনা মোতায়েন ও ভারী অস্ত্রসস্ত্র জড়ো করতে থাকে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশে নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে এ আচরণের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক প্রতিবাদ করে অচিরেই সেনা সমাবেশ বন্ধ করার দাবি জানায়। পরদিন ঘুনধুম সীমান্তের কাছে দু’দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকর্তারা পতাকা বৈঠক করেন।
এরপর ভারী অস্ত্র ও সেনা সমাবেশ বন্ধ করলেও একদিন পর মিয়ানমার আবারও বাড়তি সেনা মোতায়েন ও ভারী অস্ত্র জড়ো করতে থাকে বলে জানায় স্থানীয় অধিবাসী ও রোহিঙ্গারা।
শুক্রবার সরেজমিন পরিদর্শনের সময় তুমব্রু সীমান্তে বসবাসকারী ব্যক্তি ও শূন্যরেখায় আটকে পড়া রোহিঙ্গা শরণার্থীরা জানান, মিয়ানমার সেনারা সীমান্তের কাছ ঘেঁষে বাঙ্কার খনন করেছে ও সেখানে ভারি অস্ত্রশস্ত্র মোতায়েন করেছে।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তের ওপারে এখনও মিয়ানমারের সেনা সমাবেশ রয়েছে বলে শুক্রবার বেনারকে জানান ৫০ বিজিবির উপ-অধিনায়ক মেজর মঞ্জুরুল হাসান খান।
“মিয়ানমার সীমান্তে সে দেশের ‘সেনা’ সদস্যরা এখনো টহল দিচ্ছে। তবে বিজিবিও সর্তক অবস্থানে রয়েছে,” বলেন তিনি।
“তবে ভয়ের কারণ নেই। দেশ রক্ষায়, যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত রয়েছে বিজিবি। কেউ আক্রমণ চালালে, সমুচিত জবাব দেওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে,” জানান এই বিজিবি কর্মকর্তা।
শূন্যরেখার রোহিঙ্গারা যা বলছে
তুমব্রু সীমান্তের জিরো পয়েন্টে কোণার পাড়ায় বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের স্থান ত্যাগ করে বাংলাদেশে চলে যাওয়ার জন্য এখনো হুমকি দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন সেখানে বসবাসকারী রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ।
তিনি বেনারকে জানান, “শুক্রবার ভোর রাতেও মিয়ানমারের সেনা সদস্যরা রোহিঙ্গা শিবিরে ইট পাটকেল ও মদের খালি বোতল নিক্ষেপ করে। সীমান্তের ওপারে বাঙ্কার খনন করে প্রতিদিন টহল দিচ্ছে তারা।”
রোহিঙ্গাদের দাবি, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সদস্যরা সে দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি’র পোশাক পরে সীমান্তে টহল দিচ্ছে। যাতে কেউ বুঝতে না পারে, সীমান্তে সেনা মোতায়েন রয়েছে। এটি তাদের আরেকটি কৌশল।
এতে শূন্যরেখায় বসবাসকারী ১৩ শ’ পরিবারের ৬ হাজার রোহিঙ্গা ভয়ভীতির মধ্যে দিন কাটছে।
রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ আরও বলেন, “আমরা কখনো বাংলাদেশে যাব না, শুন্যরেখা থেকে নাগরিকত্ব নিয়ে মিয়ানমারে ফিরতে চাই।”
সীমান্তে বসবাসকারী স্থানীয়রাও ভয়ভীতির মধ্যে রয়েছে বলে বেনারকে জানান বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তের ইউপি সদস্য আবদুর রহিম।
তিনি বলেন, “সীমান্তের ওপারে পাহাড়ে তৈরি করা বেশ কয়েকটি বাঙ্কারে সেনাদের অবস্থান করতে দেখা যায়। রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে শুনেছি, ওদের সেনাবাহিনী এখন বিজিপির পোশাক পরে টহল দিচ্ছে।”
নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে জাহাঙ্গীর আজিজ বেনারকে জানান, “শূন্যরেখার ওপারে সবসময় বিজিপি, সেনা, নাটালা বাহিনীসহ রাখাইন যুবকেরা ঘোরাঘুরি করছে।”
আবদুর রহিম জানান, স্বাভাবিক অবস্থায় তুমব্রু সীমান্তে ৪০ জনের মত বিজিপি সদস্য পাহারা দেয়। এখন বিজিপি ও সেনা মিলিয়ে কমপক্ষে ২৫০ সেনাসদস্য পাহারা দিচ্ছে।
বিজিবি’র এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে জানান, “আমরা শুধু তুমব্রু-কোনাবাড়ি সীমান্তে মোতায়েন করা সেনাদের দেখতে পাই। পাহাড় ও ঘন জঙ্গলের কারণে অন্য পয়েন্টগুলোতে মোতায়েন করা সেনাদের দেখা যায় না।”