রোহিঙ্গা নির্যাতনে জড়িতদের বিচারে বাধা নেই: আইসিসি
2019.03.11
ঢাকা ও কক্সবাজার
রাখাইন রাজ্য থেকে সাড়ে সাত লাখের অধিক রোহিঙ্গাকে জোর করে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার সময় হত্যা, যৌন সহিংসতা, লুটতরাজ সংগঠিত হয়েছে কি না সেসম্পর্কে ‘প্রাথমিক পরীক্ষা’ শেষ করে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের (আইসিসি) প্রতিনিধি বলেছেন, ওই সকল অপরাধ হয়ে থাকলে অপরাধের জন্য দায়ী মিয়ানমার সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিচারের ব্যাপারে কোনো বাধা নেই।
সাত দিনের প্রাথমিক পরীক্ষা শেষ করে সোমবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে আইসিসি’র পরিচালক ফাকিসো মকোচোকো বলেন, প্রাথমিক পরীক্ষা প্রতিবেদন তদন্ত না হলেও এর মাধ্যমে নির্ধারিত হবে, দেড় বছর আগে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের ব্যাপারে কোনো ‘তদন্ত’ প্রয়োজন আছে কি না।
তিনি বলেন, প্রাথমিক পরীক্ষা প্রতিবেদনটি আইসিসি প্রসিকিউটরকে জানানো হবে। প্রসিকিউটর ফৌজদারি আদালতকে জানাবেন। আদালতের বিচারকেরা তদন্তের অনুমতি দিলেই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার বিষয়ে তদন্ত শুরু হবে।
আর তদন্ত হলে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার করা যাবে, বলেন মকোচোকো।
২০১৭ সালের আগস্ট মাসের শেষের দিকে আরাকান রোহিঙ্গা আর্মির আক্রমণের জবাবে রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর এক সামরিক অভিযান শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।
প্রাণভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা। তাঁদের অভিযোগ, মিয়ানমার সেনা সদস্য ও উগ্র বৌদ্ধরা খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুট ও অন্যান্য যুদ্ধাপরাধ করেছে।
সে বিষয়ে প্রাথমিকভাবে অবস্থা জানতে গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ সফরে আসেন ফাকিসো মকোচোকোর নেতৃত্বে আইসিসির একটি প্রতিনিধিদল। তাঁরা কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলেন।
তাঁরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য অংশীজনের সাথে সভা করেছেন। আগামীকাল তাঁরা ঢাকা ত্যাগ করবেন।
সফরটিকে ‘ফলপ্রসূ’ হিসাবে আখ্যায়িত করে মকোচোকো সাংবাদিকদের বলেন, “এই সফরে মাঠ পর্যায় থেকে উঠে আসা বিষয়গুলো প্রসিকিউটর অফিসকে জানানো হবে।”
তিনি জানান, আইসিসি প্রসিকিউটর ফাতু বেনসুদা বাংলাদেশ সফরে আসবেন।
মকোচোকো বলেন, “মিয়ানমার রোম সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ না হলেও কৃত অপরাধের জন্য হুকুমপ্রদানকারী ব্যক্তিদের বিচার করা যাবে। আইসিসি কোনো রাষ্ট্রকে অপরাধের দায়ে শাস্তি প্রদান করে না। এই আদালত ব্যক্তিদের সাজা দিতে পারে।”
তিনি বলেন, “ওই সকল অপরাধ সংগঠিত হবে জেনেও সেগুলো ঠেকাতে যারা ব্যর্থ হয়েছেন তাঁদেরও বিচার করতে পারে আদালত।
গত বছর ৬ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত জানায়, মিয়ানমার তাদের সদস্য রাষ্ট্র না হলেও, গত বছর আগস্টে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের রাখাইন থেকে গণহারে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেওয়া ও অন্যান্য সম্ভাব্য অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে তারা সেদেশের দায়ী ব্যক্তিদের বিচার করার ক্ষমতা রাখে।
এ ঘোষণার ১২ দিন পর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটর ঘোষণা করেন, তাঁর সংস্থা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার মতো অপরাধের ব্যাপারে প্রাথমিক পরীক্ষা করবে।
২০১৮ সালের ৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রাথমিক পরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রাথমিক পরীক্ষার সময় মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া জবরদস্তিমূলক যেসব কাজের কারণে বাস্তুচ্যুতি, হত্যা যৌন সহিংসতা, গুম, ধ্বংস ও লুটের ঘটেছে সেগুলো বিবেচনায় নেওয়া হবে।
রোহিঙ্গারা যা বললেন
মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন আইসিসি প্রতিনিধিদল।
রোববার (১০ মার্চ) সকালে কুতুপালং লম্বাশিয়ায় অবস্থিত আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস-এর কার্যালয়ে এ বৈঠকে প্রায় ৫০ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ অংশ নেন।
এ বৈঠকে আইসিসি প্রতিনিধি দলের সদস্যরা রোহিঙ্গাদের মুখে নির্যাতনের কাহিনি শুনেছেন বলে জানিয়েছেন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস-এর সম্পাদক ছৈয়দ উল্লাহ।
ছৈয়দ উল্লাহ বেনারকে বলেন, “আইসিসি প্রতিনিধি দল প্রথমেই আমাদের কাছ থেকে জানতে চেয়েছেন, আপনারা যে বিচার চাই, বিচার চাই বলে থাকেন তা কীসের, কোনো ঘটনার বিচার আপনারা দাবি করেন।”
তিনি বলেন, “আমরা তাদের বলেছি, মিয়ানমার সরকার ৪৭ বছর ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর ধারাবাহিকভাবে নির্যাতন চালিয়ে আসছে। তাদের জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়ে এ পর্যন্ত তিন মিলিয়নের বেশি রোহিঙ্গা মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, কানাডা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিয়ে গেছে।”
তার মতে, “শুধুমাত্র ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরে একইভাবে ১০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গাকে তারা বিভিন্নভাবে নির্যাতন করে হত্যা করেছে, এক হাজার আট’শর বেশি নারীকে তারা ধর্ষণ করেছে। এক হাজার তিনশোরও বেশি রোহিঙ্গাকে জেলে আটক রাখা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “আমাদের ঘরবাড়ি, সহায় সম্পদ পুড়িয়ে দিয়েছে। ধারাবাহিকভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর এ নির্যাতন সংঘটিত করে আসছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও মিয়ানমার সরকার। আমরা মনে করি, এটা গণহত্যার শামিল। আমরা এই গণহত্যার বিচার দাবি করে আসছি।”
বৈঠকে থাকা আরেক রোহিঙ্গা নেতা মো. আব্দুর রহিম বেনারকে বলেন, “মিয়ানমার সরকার বছরের পর বছর ধরে পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর জুলুম নির্যাতন চালিয়ে আসছে। আমাদের চোখের সামনে আমাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। স্বজনদের হত্যা করেছে। শিশুদের আগুনে ছুড়ে মেরেছে। আমরা তাদের কাছে এসবের বিচার দাবি করেছি।”
ভাসানচর বিষয়ে ইয়াংহিলির উদ্বেগ
কক্সবাজার থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে নোয়াখালী জেলার দ্বীপ ভাসানচরে স্থানান্তরের যে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার সেব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মিয়ানমারে মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের র্যাপর্টিয়ার ইয়াংহি লি।
তিনি জানুয়ারি মাসে ভাসানচর সফর করেছেন। তখন তিনি রোহিঙ্গাদের সেখানে নেওয়ার বিরোধিতা করেন।
ইয়াংহি লি জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদকে জানান, “আমার সফরের পরও আমার কাছে কিছু বিষয় অজানা। যার মধ্যে রয়েছে, ওই দ্বীপটি বসবাসযোগ্য কি না।
তিনি বলেন, “অগোছালো স্থানান্তর, এবং ইচ্ছার বাইরে স্থানান্তর নতুন সংকট সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশ সরকারের উচিত এমন কিছু যেন না হয় সে বিষয়টি বিবেচনায় রাখা।”
তবে ইয়াংহি লির উদ্বেগের জবাবে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।