মিয়ানমার ফেরত নিতে চায় এক হাজার রোহিঙ্গা, সংশ্লিষ্টরা সন্দিহান
2023.03.14
ঢাকা ও কক্সবাজার

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিপীড়নে দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে হাজার খানেকের প্রত্যাবাসনে দৃশ্যমান প্রক্রিয়া শুরু হলেও তা কতটুকু কার্যকর হবে তা নিয়ে বিশ্লেষক ও শরণার্থীরা সন্দিহান।
এর আগে ২০১৮ সালে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হলেও পরবর্তীতে তা ব্যর্থ হয়।
চীনের উদ্যোগে পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রথম পর্যায়ে প্রত্যাবাসনের জন্য যাচাই-বাছাই সম্পন্ন হওয়া এক হাজার রোহিঙ্গার সাথে আগামী ১৫ মার্চ বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ কর্মকর্তারা প্রত্যাবাসন বিষয়ে বৈঠক করবেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আন্তর্জাতিক চাপের পরিপ্রেক্ষিতে ১১ লাখ রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে মাত্র এক হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে চীন মূলত মিয়ানমারের স্বার্থকে রক্ষা করবে।
এদিকে মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় ফিরে যাওয়া ওইসব রোহিঙ্গাদের জন্য দুটি আশ্রয় শিবির প্রস্তুত করা হয়েছে বলে বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়াকে জানিয়েছেন (আরএফএ) রাখাইন রাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেল ও রাজ্যের মুখপাত্র হ্লা থেইন।
এদিকে কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান সোমবার বেনারকে জানান, “একটি পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গাকে পুনর্বাসিত করার একটি প্রস্তাবের বিষয়ে গত দুই-তিন বছর ধরে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা চলছে।”
তাঁর মতে, প্রকৃত প্রত্যাবাসন এখনো “অনেক দূরে।”
এখন যাঁদের প্রত্যাবাসনের কথা চলছে তাঁদের পরিচয় যাচাই (ভেরিফিকেশন) শেষ হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, “যাচাই শেষ হওয়ার পর প্রত্যাবাসনের আরও অনেক ধাপ রয়েছে।”
“তবে আমরা কিছুটা অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি। মিয়ানমার সরকার সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকজন রাষ্ট্রদূতকে রাখাইন রাজ্য সফরে নিয়ে গেছে। সুতরাং, আমরা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে আশাবাদী হতে পারি,” বলেন মিজানুর রহমান।
“চীন সরকার প্রত্যাবাসনে সহায়তা করছে,” জানান তিনি।
এদিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে নিজেদের উদ্যোগের বিষয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের সম্প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত করেছে মিয়ানমারের সামরিক সরকার।
গত আট মার্চ সামরিক সরকারের ইউনিয়ন মিনিস্টার কো কো হ্লাইয়াং এর নেতৃত্বে একটি সরকারি প্রতিনিধিদল রাখাইনে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য তৈরি করা দুটি শিবির দেখাতে মিয়ানমারে চীন, ভারত ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতসহ আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর কূটনীতিকদের নিয়ে যায়।
নার খু ইয়া ও হ্লা ফ খুয়াং নামে প্রস্তুত করা ওই দুটি শিবিরে ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য জীবিকা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা বিষয়ক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে বলে জান্তা সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয় কূটনীতিকদের।
“আমরা বিদেশি কূটনীতিকদের জানিয়েছে যে কাঠামোবদ্ধভাবেই কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে,” আরএফএকে বলেন হ্লা থেইন।
তিনি জানান, শিগগিরই রাখাইন রাজ্যের সমাজকল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রী ও অভিবাসন বিভাগের প্রধান অং মিও ও এর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল প্রত্যাবাসন বিষয়ে আলোচনার জন্য বাংলাদেশ সফর করবে।
“আলোচনা শেষে যখন প্রতিনিধি দলটি ফিরে আসবে, তখনই নির্দিষ্ট করে বলা যাবে যে কতজনকে গ্রহণ করা হবে, পাশাপাশি আলোচনায় যে সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে, সেগুলোও বাস্তবায়িত হবে,” বলেন অ্যাটর্নি জেনারেল হ্লা থেইন।
কী এই পাইলট প্রকল্প?
গত ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হয়। ওই সভার কার্যপত্রে উল্লেখ করা হয়, ২০২০ সালের প্রথমার্ধে চীনের সম্পৃক্ততায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি ত্রি-পক্ষীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের বন্ধুরাষ্ট্র চীনের মধ্যস্থতায় একটি পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে সীমিত সংখ্যক রোহিঙ্গার টেকসই প্রত্যাবাসন শুরু করার বিষয়ে আলোচনা হয়।
২০২১ সালের অক্টোবরে এই প্রকল্পের অধীনে ৭১১ জন মুসলিম রোহিঙ্গা এবং ৩১৭ জন হিন্দু রোহিঙ্গার দুটি তালিকা পাঠানো হয়। দুই পক্ষ থেকে এই ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু করার সিদ্ধান্ত না হওয়ায় পুরো প্রক্রিয়া স্থবির হয়েছিল। তবে গত সপ্তাহ থেকে পাইলট প্রকল্পটির মাধ্যমে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়টি সামনে আসে।
ওই তালিকার অন্তর্ভুক্ত রোহিঙ্গাদের অনেকেই সোমবার শরণার্থী শিবিরের ক্যাম্প ইনচার্জের সঙ্গে প্রত্যাবাসন সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
প্রসঙ্গত ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট উত্তর রাখাইন রাজ্যে সামরিক অভিযানের পর লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে নিজ বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ হয়। এ সময় প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেন। এর আগে থেকেও অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে বসবাস করছিলেন। সব মিলিয়ে কক্সবাজারের শরণার্থীশিবিরগুলোতে বর্তমানে রয়েছেন প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা।

রোহিঙ্গাদের সাথে প্রত্যাবাসন বৈঠক
কক্সবাজারের টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা মাহমুদা বেগমের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১০। সোমবার সকালে তাঁরা সবাই ক্যাম্প ইনচার্জের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।
“ক্যাম্প ইনচার্জ আমাদের কাছ থেকে পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে শুনেছেন। সদস্য সংখ্যা বেড়েছে নাকি কমেছে সেই বিষয়ে জানতে চেয়েছেন,” বেনারকে বলেন মাহমুদা বেগম।
আগামী বৃহস্পতিবার জাতিসংঘসহ মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে “আমাদের সাক্ষাতের কথা রয়েছে.” জানিয়ে মাহমুদা বলেন, “মিয়ানমারে অবস্থান সম্পর্কিত দলিলপত্র সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার কথাও বলা হয়েছে।”
মিয়ানমার থেকে যাচাই করা তালিকায় তাঁর পরিবারের নাম রয়েছে জানিয়ে আরেক শরণার্থী মোহাম্মদ আলম বেনারকে জানান, বৃহস্পতিবার তাঁকেও প্রত্যাবাসন বিষয়ক বৈঠকে থাকতে বলা হয়েছে।
“নিঃসন্দেহে আমরা নিজ দেশে ফিরতে চাই,” মন্তব্য করে আলম বলেন, “তবে ফেরার আগে সেখানে আমাদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। না হলে ২০১৭ সালের আগস্টের ঘটনা পুনরাবৃত্তি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।”
বৃহস্পতিবার বৈঠকের পর “প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে জানা যাবে,” বলে বেনারকে জানান টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি নুরুল আলম।
২০২২ সালের ২১ ডিসেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রথমবারের মতো মিয়ানমার এবং রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ক একটি সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রোহিঙ্গারা যাতে নিজ দেশে স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও টেকসইভাবে ফিরে যেতে পারে সেই ব্যাপারে একটি অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
উল্লেখ্য, এবারই প্রথম মিয়ানমারের দুই বন্ধু রাষ্ট্র ও নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য চীন ও রাশিয়া মিয়ানমার সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্তে ভেটো দেয়নি।
মিয়ানমারের স্বার্থ রক্ষা করছে চীন?
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন সোমবার বেনারকে বলেন, “পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুর প্রক্রিয়াটি আমি সমর্থন করি না। এটি কোনো টেকসই প্রচেষ্টা নয়। প্রত্যাবাসন তখনই বলা যাবে যখন মিয়ানমারের ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীরা স্বেচ্ছায় রাখাইনে ফিরে যাবে।”
তিনি বলেন, “এই পাইলট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এক হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিয়ে তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখাতে চাইবে যে, তারা খুব ভালো মানুষ এবং প্রত্যাবাসন চলছে। কিছু দিন পর দেখা যাবে আর নিচ্ছে না।”
তৌহিদ হোসেন বলেন, “এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে চীন সম্পৃক্ত রয়েছে। এই প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে মিয়ানমারের স্বার্থই রক্ষা করবে চীন; বাংলাদেশের নয়।”
তিনি আরও বলেন, “রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপারে গত পাঁচ বছরে চীন যে ভূমিকা পালন করেছে তা থেকে এটি স্পষ্ট, তাদের কাছে মিয়ানমারের স্বার্থই বড়ো, বাংলাদেশের নয়।”
“রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের দায়িত্ব মিয়ানমারের। রাখাইনের পরিস্থিতি উন্নত করার দায়িত্বও মিয়ানমার সরকারের। তারা সেই ভূমিকা পালন করলে রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় তাদের দেশে ফিরে যাবেন,” যোগ করেন তিনি।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছে রেডিও ফ্রি এশিয়ার বার্মিজ সার্ভিস।