প্রত্যাবাসনে হঠাৎ উদ্যোগী মিয়ানমার, অশান্ত রোহিঙ্গা শিবির

কামরান রেজা চৌধুরী ও সুনীল বড়ুয়া
2023.03.16
ঢাকা ও কক্সবাজার
প্রত্যাবাসনে হঠাৎ উদ্যোগী মিয়ানমার, অশান্ত রোহিঙ্গা শিবির কক্সবাজার উখিয়ায় একটি রোহিঙ্গা শিবিরের সামনে শরণার্থীরা। ১২ জানুয়ারি ২০২৩।
[সুনীল বড়ুয়া/বেনারনিউজ]

একদিকে দীর্ঘ বিরতির পরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার হঠাৎ উদ্যোগী হয়ে উঠেছে মিয়ানমার, অন্যদিকে অশান্ত হয়ে উঠছে রোহিঙ্গা শিবিরগুলো। গত ২৪ ঘণ্টায় উখিয়ার বালুখালী আশ্রয় শিবিরে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন দুই রোহিঙ্গা। এ ছাড়া টেকনাফে অপহৃত হয়েছেন নয় রোহিঙ্গা।

বাংলাদেশের পাঠানো তালিকা যাচাইয়ে ইতোমধ্যে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল কক্সবাজারে তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেছে। সেখানে বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের কূটনীতিকেরা উপস্থিত ছিলেন।

এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার সকালে বালুখালী ৯ নম্বর ক্যাম্প এলাকা থেকে মাহাবুবুর রহমান (৩৫) নামে এক রোহিঙ্গা যুবকের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।

“মাহাবুবুর রহমান ৫ নম্বর ক্যাম্পে তাঁর শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে থেকে একদল দুর্বৃত্ত তাঁকে ধরে ৯ নম্বর ক্যাম্পে নিয়ে হত্যা করে,” বেনারকে বলেন উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী।

তিনি আরও জানান, মাহাবুবুর রহমানকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর হাত-পা বাঁধা ছিল। এছাড়া তাঁর শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।

এর আগে বুধবার ভোরে মোহাম্মদ রশিদ (৩৫) নামে এক রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবককে গুলি করে দুর্বৃত্তরা।

রশিদ বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরের একটি এনজিও কার্যালয়ে রাতে ডিউটি করে নিজের ঘরে যাওয়ার সময় হত্যার শিকার হন বলে জানান শেখ মোহাম্মদ আলী।

“হত্যাকাণ্ডের কারণ এখনো বের করা যায়নি,” জানিয়ে ওসি বলেন, “আমরা সন্দেহ করছি, আরসা সদস্যরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারে।”

নিহত মাহাবুবুর রহমান দিন মজুরের কাজ করে সংসার চালাতেন বলে বেনারকে জানান বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা আলম।

“তবে তাঁর ভাই মুজিবুর রহমান আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমার ধারণা এর জের ধরে তাকে হত্যা করা হয়েছে,” বলেন আলম।

নয় রোহিঙ্গা অপহৃত

টেকনাফের পাহাড়ে গাছের শুকনো ডাল সংগ্রহ করতে গিয়ে দুই শিশুসহ নয় রোহিঙ্গা অপহরণের শিকার হয়েছেন। টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ (পরিদর্শক) মো. মশিউর রহমান বেনারকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

তিনি বলেন, “বৃহস্পতিবার সকালে টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের জাহাজপুরা এলাকায় অপহরণের ঘটনা ঘটে। সকাল ১১টার দিকে অস্ত্রের মুখে একদল রোহিঙ্গা দুর্বৃত্ত তাদের অপহরণ করে। বিষয়টি জানতে পেরে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছালে দুর্বৃত্তরা দুই শিশুকে ছেড়ে দেয়।”

‘খুনিদের চেনা গেলেও কিছু বলা যাচ্ছে না’

রোহিঙ্গা শিবিরে একের পর এক হত্যার ঘটনায় আতঙ্কে রয়েছেন শরণার্থীরা। বালুখালী ৯ নম্বর শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা (মাঝি) মাসুদ বলেন, “ক্যাম্পে এখন প্রতিদিন খুনের ঘটনা ঘটছে। প্রকাশ্যে এসে ঘর থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করা হচ্ছে। অনেক সময় খুনিদের চেনা গেলেও কিছুই বলা যাচ্ছে না। যে বলবে, কোনো সময় তাকেও খুন করা হবে।”

“ক্যাম্পগুলো পাহাড়ি এলাকায় হওয়ায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কন্ট্রোল করতে পারছে না। এই পরিস্থিতিতে শিবিরগুলোর দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে দেওয়া দরকার,” যোগ করেন এই রোহিঙ্গা নেতা।

আশ্রয় শিবিরে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও আরেক সশস্ত্রগোষ্ঠী আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে।

পুলিশের হিসাব মতে, গত ৫ মাসে ২৬টি ঘটনায় ৩১ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৪ জন মাঝি (রোহিঙ্গা নেতা), ৮ জন আরসা সদস্য এবং ৯ জন স্বেচ্ছাসেবক ও সাধারণ রোহিঙ্গা।

ক্যাম্পের বাসিন্দাদের মতে, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের বিরোধী আরসা।

প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, ‘রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফেরত যাক তা কিছু লোক চায় না। যারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চায় না তারাই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে।’

এদিকে উখিয়ার ১৮ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরে অভিযান চালিয়ে আরসার দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

র‌্যাবের সহকারী পরিচালক মো. শামসুল আলম খান জানান, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে যৌথ অভিযান চালিয়ে জিয়াউর রহমান (২৩) ও মো. শাকের (৩৩) নামে দুই আরসা সদস্যকে আটক করা হয়েছে।

জিয়াউর রহমান ও শাকের দুই জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা রয়েছে বলে জানান র‌্যাবের এই কর্মকর্তা।

26212.jpg
টেকনাফ স্থল বন্দরের রেস্ট হাউজে এক রোহিঙ্গা পরিবারের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন মিয়ানমার প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। ১৬ মার্চ ২০২৩। [বেনারনিউজ]

প্রত্যাবাসন না হওয়ায় হতাশা

কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “৩৩টি রোহিঙ্গা শিবিরের একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা দীর্ঘ দিন অবস্থানের কারণে তাঁদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল চরমে পৌঁছেছে। এছাড়া প্রত্যাবাসন না হওয়ায় তাঁদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা বিরাজ করছে।”

তিনি আরও বলেন, “আধিপত্য বিস্তার নিয়ে তারা প্রতিদিন লড়াই করছে, মারামারি, খুন, অস্ত্র ও মাদক চোরাচালান, নারী নির্যাতন, মানবপাচারের মতো অপরাধে তারা জড়িয়ে পড়েছে।”

“রোহিঙ্গা শিবিরগুলো পাহাড়ি এলাকায় হওয়ায় সেখানে অভিযান চালানো অনেকটা কঠিন। কোনো একটা অপরাধ করেই তারা পাহাড়ে ঢুকে যায়। অনেকে আবার মিয়ানমার বর্ডারে চলে যায়,” বেনারকে বলেন ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সহকারী পুলিশ সুপার মো. ফারুক আহমেদ।

এদিকে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) মহাপরিচালক (ডিজি) এম খুরশীদ হোসেন জানিয়েছেন, শিগগির রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হবে।

বৃহস্পতিবার র‌্যাব সদর দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এই কথা জানান তিনি।

প্রতিবেদনটি তৈরিতে টেকনাফ থেকে সহায়তা করেছেন আব্দুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।