প্রতীক মুছে জাতিসংঘ নৌকায় মিয়ানমারের জান্তা কর্মকর্তাদের বাংলাদেশ সফর

রেডিও ফ্রি এশিয়া, বার্মিজ
2023.03.17
প্রতীক মুছে জাতিসংঘ নৌকায় মিয়ানমারের জান্তা কর্মকর্তাদের বাংলাদেশ সফর টোকিওর সফিয়া ইউনিভার্সিটিতে ২০১৪ সালে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি বিষয়ক আন্তর্জাতিক মিডিয়া সেমিনারে বক্তৃতা করছেন ক্রিস গিনেস।
[ছবি: জাতিসংঘ]

মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের কর্মকর্তাদের চলমান বাংলাদেশ সফরের জন্য জাতিসংঘ থেকে নৌকা সরবরাহ করা হয়েছিল। এমনকি নৌকাগুলো থেকে জাতিসংঘের প্রতীকও মুছে ফেলা হয়েছিল বলে মিয়ানমারে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর একটি ইমেইল বার্তা থেকে জানা গেছে।

এধরনের কাজ মানবিক সহায়তা কর্মীদের ঝুঁকিতে ফেলতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে ওই ইমেইল বার্তায়।

মিয়ানমারে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী রামানাথন বালাকৃষ্ণনের বৃহস্পতিবার পাঠানো ইমেইল অনুসারে, মিয়ানমার কর্মকর্তাদের বুধবার বাংলাদেশের কক্সবাজারে নিয়ে যাওয়ার জন্য জাতিসংঘের নৌকা ব্যবহার করা হয়েছিল।

ইমেইলটি লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ‘মিয়ানমার অ্যাকাউন্টিবিলিটি প্রজেক্ট’ এর হাতে পৌঁছানোর পর তারা সেটি বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়াতে (আরএফএ) পাঠায়।

বর্তমানে ‘মিয়ানমার অ্যাকাউন্টিবিলিটি প্রজেক্ট’ মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর সদস্যদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা তৈরি করতে কাজ করছে।

বাংলাদেশ থেকে প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করানোর উদ্দেশ্যে চীনের মধ্যস্থতায় একটি পাইলট প্রকল্প নিয়ে দেশটির কর্মকর্তারা বর্তমানে বাংলাদেশ সফরে রয়েছেন। এই সফরে তাঁরা প্রত্যাবাসন বিষয়ে নির্ধারিত রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন।

মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশ সফরের জন্য বুধবার প্রতীকবিহীন জাতিসংঘের নৌকাগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল।

সশস্ত্র পাহারা ছাড়াই জান্তা কর্মকর্তারা এই সফর করেছেন। কোনো নৌকায় কোনো অস্ত্র দেখা যায়নি বলে ইমেইলে লিখেছেন বালাকৃষ্ণন।

তবে এই সফরটি জাতিসংঘের সকল সংস্থার জন্য “সুনাম সংকট” তৈরি করেছে এবং কর্মীদের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে বলেও ওই ইমেইলে সহকর্মীদের জানিয়েছেন তিনি।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি মিয়ানমারের জান্তা কর্মকর্তাদের “অত্যন্ত প্রবল অনুরোধে” নৌকাগুলো সরবরাহ করেছে বলে ইমেইলে জানিয়েছেন বালাকৃষ্ণন।

মিয়ানমার অ্যাকাউন্টিবিলিটি প্রজেক্টের পরিচালক ও জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা ক্রিস গিনেস এর মতে “নৌকাগুলো থেকে জাতিসংঘের লোগো অপসারণ একটি গুরুতর নিরাপত্তা লঙ্ঘন।”

“এটি জাতিসংঘের নিরপেক্ষতার একটি গুরুতর লঙ্ঘন এবং এটি মিয়ানমারে জাতিসংঘের সকল কর্মসূচিকে বিপদে ফেলেছে,” আরএফএকে বলেন গিনেস।

তিনি বলেন, “যদি বিদ্রোহী গোষ্ঠী, বিরোধী দল এবং অন্যরা মনে করে যে এই পরিবহনগুলো এবং এই সাহায্য কর্মসূচিগুলো জান্তা সরকারের কর্মকর্তাদের স্বার্থে ব্যবহার হচ্ছে, তবে তারা আক্রমণের শিকার হতে পারেন। এটি মিয়ানমার জুড়ে মানবিক কর্মীদের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।”

পাইলট প্রোগ্রামে ইউএনএইচসিআর জড়িত নেই

মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার প্রায় ১০ লাখ নির্যাতিত রোহিঙ্গা শরণার্থী বাস করেন। এদের মধ্যে প্রায় সাড়ে সাত লাখ মানুষ ২০১৭’র আগস্ট থেকে রাখাইন রাজ্যে শুরু হওয়া সামরিক দমন অভিযানের পর মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছেন।

এদের মধ্য থেকে হাজারখানেক রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার ফিরিয়ে নিতে সফররত প্রতিনিধিদল বুধবার থেকে এ পর্যন্ত ২৪০ জনের বেশি শরণার্থীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত শরণার্থী ও প্রত্যাবাসন কমিশনার খালিদ হোসেন।

আগামী কয়েকদিনে আরো সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

তবে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে প্রত্যাবাসন বিষয়ক এই পাইলট প্রোগ্রামের আলোচনায় ইউএনএইচসিআর জড়িত নেই বলে জানিয়েছেন বালাকৃষ্ণন।

রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে “জাতিসংঘ এবং ইউএনএইচসিআরের অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে,” জানিয়ে তিনি বলেন “রাখাইনের পরিস্থিতি বর্তমানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য অনুকূল নয়।”

জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিক নিউ ইয়র্কে শুক্রবার দুপুরের ব্রিফিংয়ে পুনরায় বলেছেন, ইউএনএইচসিআর এই পাইলট প্রোগ্রামের সাথে জড়িত নয়।

রাখাইনের অনিরাপদ পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বালাকৃষ্ণনের বক্তব্যেরই পুনরাবৃত্তি করেন।

লোক দেখানো প্রচারাভিযান?

গিনেস বলেছেন, দৃশ্যত জান্তা সরকার জাতিসংঘকে “একটি জঘন্য প্রচারমূলক লোকদেখানো” কাজে ব্যবহার করেছে। কারণ শাসকগোষ্ঠী এই বছরের শেষের দিকে “ভুয়া নির্বাচন” করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

“জাতিসংঘ একদিকে বলছে এটি বিপজ্জনক এবং অন্যদিকে ঠিকই এগিয়ে যাচ্ছে এবং এই পাইলট প্রকল্পকে সমর্থন করছে,” যা সাধারণ ব্যাপার নয়।

‘বার্মা ক্যাম্পেইন যুক্তরাজ্যে’র ক্যাম্পেইন অফিসার কারিন ভ্যাল্টারসন বলেছেন, “পাইলট প্রোগ্রামটি বার্মার সামরিক বাহিনী এবং বাংলাদেশ সরকারের জনসংযোগ অনুশীলন কার্যক্রমের মতো মনে হচ্ছে।”

“রাখাইন রাজ্যের ভেতরের অবস্থা এখনও চলমান গণহত্যার পরিস্থিতি। তারা এই মুহূর্তে ফিরে আসতে পারে না এবং আমি মনে করি না যে কেউ ফিরে আসবে,” আরএফএকে বলেন কারিন।

তিনি বলেন, “এতে জাতিসংঘের সংস্থার জড়িত থাকা সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলো স্পষ্টতই লজ্জাজনক।”

তাঁর মতে, এই মুহূর্তে ফিরে আসার পরিবর্তে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় শিবিরে সহায়তার প্রয়োজন, যাতে তাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তাসহ একটি পরিচ্ছন্ন জীবনযাত্রার মান থাকতে পারে।

তিনি বলেন, “শরণার্থী শিবিরে নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের আবার পরিত্যাগ করতে পারে না।"

প্রতিবেদনটিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে আবদুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।