ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের উদ্যোগকে স্বাগত: ইউএনএইচসিআর
2019.03.21
ঢাকা ও কক্সবাজার

কক্সবাজারের ঘিঞ্জি শরণার্থী শিবির থেকে রোহিঙ্গাদের নোয়াখালীর ভাসানচরের উন্নত আবাসস্থলে স্থানান্তরের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর।
বৃহস্পতিবার পাঁচ দিনের সফর শেষে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে সংস্থাটির সহকারী হাইকমিশনার ভল্ক টার্ক জানান, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের বিষয়টি স্বেচ্ছাধীন হতে হবে। সেখানে তাঁদের জীবন-জীবিকা ও অন্যান্য সুবিধা থাকতে হবে।
এ ব্যাপারে জাতিসংঘ বাংলাদেশ সরকারের সাথে আলোচনা করেছে এবং তা চালিয়ে যাবে বলে তিনি জানান। তবে শরণার্থীরা ভাসানচরে যেতে রাজি নন বলে বেনারকে জানিয়েছেন রোহিঙ্গা নেতারা।
ভল্ক টার্ক সাংবাদিকদের বলেন, “আপনারা জানেন রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সাথে জাতিসংঘ আলোচনা করছে এবং আমাদের জন্য এই আলোচনা চালিয়ে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ।”
“রোহিঙ্গাদের বিকল্প বসবাসের স্থান চিহ্নিত করার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে তাকে আমরা স্বাগত জানাই,” বলেন ভল্ক টার্ক।
তিনি বলেন, “আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো স্থানান্তর যেন স্বেচ্ছায় হয় তা নিশ্চিত করতে একসাথে কাজ করে যাওয়া।”
“আমরা কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের সাথে আলোচনা করেছি এবং বলেছি যে ভাসানচরে তোমাদের স্থানান্তরের ব্যাপারে আমরা সরকারের সাথে আলোচনা করছি,” বলেন ভল্ক টার্ক।
রোহিঙ্গাদের অনীহা
ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের ব্যাপারে সরকারের পদক্ষেপকে স্বাগত জানালেও অধিকাংশ শরণার্থী স্বেচ্ছায় সেখানে যেতে রাজি নয়।
উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প-১ এর সেক্রেটারি মো. আলম বেনারকে বলেন, ভাসানচরে যাওয়ার বিষয়ে ক্যাম্প ইনচার্জের সঙ্গে ক্যাম্প সেক্রেটারি, হেড মাঝি, ব্লক মাঝিসহ রোহিঙ্গা নেতাদের বৈঠক হয়েছে।
তিনি বলেন, “ইউএনএইচসিআর কর্মকর্তাদের সাথেও ভাসানচরে যাওয়ার ব্যাপারে রোহিঙ্গা নেতাদের বৈঠক হয়েছে। তারা আমাদের কাছ থেকে নামের তালিকা চেয়েছিল। কিন্তু কেউ সেখানে যেতে আগ্রহী নন। সে কারণে তালিকা দেওয়া হয়নি।”
তিনি আরো বলেন, “এত দূরে গেলে আমরা আর মিয়ানমারে ফিরতে পারব না। তা ছাড়াও ওখানে আমাদের জীবনের নিরাপত্তা নেই।”
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস-এর সেক্রেটারি ছৈয়দ উল্লাহ বেনারকে বলেন, “আমরা ভাসানচরে যাব না। আমরা নিরাপত্তার জন্য এখানে এসেছি কিন্তু সেখানে তো আমাদের নিরাপত্তা নেই।”
তিনি বলেন, “রোহিঙ্গারা ভাসানচরে যাবে কি না সে ব্যাপারে শরণার্থীদের সাথে কথা বলতে আমাদের বলা হয়েছিল। আমরা অনেক রোহিঙ্গার সাথে কথা বলে দেখেছি। কিন্তু কেউ স্বেচ্ছায় সেখানে যেতে রাজি নয়।”
“আমরা শুনেছি, ওখানে পানি ওঠে, বন্যা হয়। এ অবস্থায় সেখানে আমাদের জানমালের নিরাপত্তা নেই,” বলেন ছৈয়দ উল্লাহ।
কুতুপালং ক্যাম্প-৪ এর ও জোনের হেড মাঝি আব্দুর রহিম বেনারকে বলেন, “আমরা অনেককে সেখানে যাওয়ার জন্য বুঝিয়েছি। কিন্তু কেউ যেতে রাজি নয়। রোহিঙ্গারা বলছে, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাওয়ার আগে মাঝিদের একটি প্রতিনিধি দলকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হউক।”
সাধারণ রোহিঙ্গাদের উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, “মাঝিরা দ্বীপটি দেখার পরে বাসযোগ্য বলে জানালে তারপর রোহিঙ্গারা সেখানে যাবে। এর আগে নয়।”
আব্দুর রহিম বলেন, যা শুনেছি, ছবিতে যা দেখেছি তাতে দ্বীপটি আমার ভালো লেগেছে। কেউ না গেলেও আমি আমার পরিবার নিয়ে চলে যাব।”
২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর সামরিক অভিযান শুরু করলে প্রাণভয়ে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।
তারা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের শরণার্থী শিবিরে গাদাগাদি করে নোংরা পরিবেশে বসবাস করছে। তাদের উন্নত পরিবেশে বসবাসের জন্য নোয়াখালী জেলার ভাসানচরে নির্মিত হয়েছে আবাসিক এলাকা।
সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরের কাজ শুরু হবে আসন্ন এপ্রিলে।
ভল্ক টার্ক বৃহস্পতিবার তাঁর পাঁচ দিনের বাংলাদেশ সফর শেষ করেছেন। এর আগে তিনি ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ সফরে আসেন।
বাংলাদেশে অবস্থানকালে তিনি রোহিঙ্গাদের ‘স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদার সাথে’ মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর সম্পর্কে সংবাদ সম্মেলনে তাঁর দেওয়া এই বক্তব্য সম্পর্কে তাৎক্ষিণক মন্তব্য করতে চাননি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
এর আগে বাংলাদেশ সফর এসে গত ২৩ জানুয়ারি ভাসানচর পরিদর্শন করেন মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি।
তিনি সেদিন বেনারকে বলেন, “নির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত শরণার্থী স্থানান্তর পরিকল্পনার গতি কিছুটা শ্লথ রাখার অনুরোধ জানাচ্ছি। আগে সেখানকার মানবিক, মানবাধিকার ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির মূল্যায়ন করা উচিত।”
তিনি বলেন, “আমার মনে হয় সরকার ফের সেখানে বাসযোগ্যতার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে সমীক্ষা চালাবে এবং তার ফলাফল জাতিসংঘ এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের দেবে। তখন বোঝা যাবে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর আদৌ কতটা সম্ভব।”
এদিকে গত ৪ মার্চ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন, এ বছর এপ্রিলের মধ্যে এক লাখ রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর শুরু হবে।