মিয়ানমারে গণহত্যা: যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণায় ‘ন্যায়বিচারের পথ সুগম হবে’ রোহিঙ্গাদের

বেনারনিউজ বিশেষ প্রতিবেদন
2022.03.22
যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি’র হলোকস্ট মেমোরিয়াল যাদুঘরে অনুষ্ঠিত ‘বার্মার গণহত্যার নীলনকশা’ শীর্ষক প্রদর্শনী দেখছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন। ২১ মার্চ ২০২২।
[এএফপি]

রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ করা হয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। বিশ্লেষকদের মতে, ভবিষ্যতে যাতে মিয়ানমারে আরো নৃশংসতা না ঘটে সে জন্য অবশ্যই প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন সোমবার বলেছেন, গণহত্যার বিষয়টি নিরূপণ করা হয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও তাঁর বিভাগের নিজস্ব অনুসন্ধানের তথ্য ও স্টেট ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক প্রস্তুতকৃত একটি “মূল্যায়ন ও আইনি বিশ্লেষণের” পর্যালোচনার ওপর ভিত্তি করে।”

২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মুসলিম সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ওপর নৃশংস দমন-পীড়ন করে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকার। পাশাপাশি, সাত লাখ ৪০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গাকে প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। ২০১৬ সালে একটি ক্র্যাকডাউনে রাখাইন থেকে নব্বই হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।

সহিংসতার শিকার হয়ে পালিয় যাওয়া এই রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ শরণার্থী শিবিরে মানবেতরভাবে বসবাস করছেন।

“আমরা আশা করি এই স্বীকৃতির মাধ্যমে সামরিক নেতৃত্বের অপরাধীরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে অনেক বেশি চাপের মধ্যে থাকবে। যা আমাদের দেশের ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলজনক হবে,” বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়াকে (আরএফএ) বলেন বর্মি রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন ইউকে-এর সভাপতি তুন খিন।

তিনি বলেন, “আমার বিশ্বাস এই স্বীকৃতির ফলে রোহিঙ্গা জনগণ, অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি মিয়ানমারের নাগরিকদের যারা প্রতিনিয়ত সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন এবং অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছেন তাদের জন্য ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ সুগম হবে।”

তবে ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া প্রোগ্রামের সিনিয়র সহযোগী মারে হিবার্ট মনে করেন দমন-পীড়নের জন্য মিয়ানমারের জেনারেলদের উপর ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা সামরিক বাহিনীর নৃশংস আচরণে কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি।

তিনি বলেন, “সর্বশেষ ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতেও অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করেছে সামরিক বাহিনী এবং তখন থেকে হাজার হাজার নাগরিককে আক্রমণ ও হত্যা করে চলছে।”

একটি ইমেইল বার্তায় হিবার্ট আরএফএকে বলেন, জাতিসংঘের অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞাগুলো সম্ভবত চীন এবং রাশিয়ার মাধ্যমে অবরুদ্ধ হবে।

তিনি বলেন, “কিছু মানবাধিকার কর্মী বাইডেন প্রশাসনকে আহবান জানিয়েছেন, যেন মিয়ানমার থেকে তেল ও গ্যাস রপ্তানি বন্ধ করে দেয়া হয়।”

জেনোসাইড ডকুমেন্টেশন সেন্টার, কম্বোডিয়ার বার্মিজ রিসার্চ ফেলো এবং জেনোসাইড ওয়াচের উপদেষ্টা মং জারনি আরএফএকে বলেন, সোমবারের ঘোষণা অনুযায়ী অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে অবশ্যই নির্দিষ্ট পদক্ষেপ অনুসরণ এগুতে হবে।

“যদি এই ঘোষণা বার্মিজ সামরিক বাহিনীর ওপর সরাসরি প্রভাব তৈরি না করে এবং এটিকে প্রধান অপরাধী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আক্রান্ত না করে তবে এর কোনো প্রভাবই যথাস্থানে তৈরি হবে না,” ইমেইল বার্তায় বলেন এই বিশ্লেষক।

মং জার্নি ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর সাথে একটি আন্তর্জাতিক বলয় তৈরি করে মিয়ানমারের ওপর একটি বৈশ্বিক চাপ তৈরির নেতৃত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বাইডেন প্রশাসনকে; কারণ তারা ইউক্রেন আক্রমণের প্রেক্ষাপটে আর্থিক, বাণিজ্যিক এবং বহুপাক্ষিক নিষেধাজ্ঞায় থাকা রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক বাড়ানোর চেষ্টা করবে।

এই ঘোষণা অবিস্মরণীয় মাইলফলক

জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও মিয়ানমারে বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টিনা ফিঙ্ক বলেন, যদিও রাখাইনে যা ঘটেছে তাকে গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করার ব্যাপক পরিণতি তাৎক্ষণিকভাবে স্পষ্ট নয়, তবে ব্লিনকেনের এই ঘোষণা রোহিঙ্গাদের জন্য গভীরভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।

এক ইমেইল বার্তায় তিনি বলেন, “তাঁরা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হাতে ভয়ঙ্কর শারীরিক এবং মানসিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন, কিন্তু মিয়ানমারের প্রতিবেশী বা সকল সরকার তাদেরকে পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি।”

“মার্কিন সরকারের এই দৃঢ় অবস্থানের ফলে এটা স্পষ্ট যে রোহিঙ্গারা প্রকৃতপক্ষে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার শিকার হয়েছেন। এই ঘোষণা রোহিঙ্গা জনগণের মর্যাদা পুনরুদ্ধার করেছে,” বলেন ক্রিস্টিনা ফিঙ্ক। 

তাঁর মতে, এই ঘোষণা গাম্বিয়া কর্তৃক আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) আনা চলমান মামলাকে প্রভাবিত করতে পারে। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ এনে পশ্চিম আফ্রিকার এই দেশটি মিয়ানমারের সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ১৯৪৮ সালের গণহত্যা কনভেনশন লঙ্ঘনের অভিযোগ দায়ের করেছে আইসিজেতে।

“রোহিঙ্গাদের বেশির ভাগই মুসলিম বলে একটি মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে গাম্বিয়া এই অভিযোগটি এনেছে- এমন প্রচার করে মিয়ানমারের সামরিক শাসকরা এই মামলাটিকে ছোট করার চেষ্টা করে আসছিল,” বলেন তিনি।

ফিঙ্ক বলেন, “মার্কিন সরকারের দৃঢ় অবস্থান প্রমাণ করে এটি ধর্মীয় অনুভূতি নয়, বরং নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা এবং সকল নাগরিকের সমান অধিকারকে সুরক্ষা দেয়ার বিষয়।”

মিয়ানমারের উইমেনস পিস নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক ওয়াই ওয়াই নু, যিনি একজন রাজনৈতিক বন্দিও ছিলেন, আরএফএকে বলেন, নিহত বা বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জন্য এবং তাঁদের পরিবারের জন্য এই ঘোষণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

“মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি শক্তিশালী দেশের গণহত্যার এই ঘোষণাটি দেয়া একটি সরকারি অঙ্গীকার বা প্রতিশ্রুতির মতো যে, দেশটি আমাদের দেশে গণহত্যাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করতে সহায়তা নিয়ে সোচ্চার থাকবে,” যোগ করেন তিনি।

দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় মানবাধিকার সংগঠন ফোর্টিফাই রাইটস, যারা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনাগুলো নথিভুক্ত করেছে, এই স্বীকৃতিটিকে ‘ঐতিহাসিক’ বলে অভিহিত করেছে এবং জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যাকে প্রকাশ্যে স্বীকার করতে এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাছে একটি প্রস্তাব পেশ করার আহবান জানিয়েছে।

ফোর্টিফাই রাইটস-এর মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ জাও উইন এক বিবৃতিতে বলেন, “এটি নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের এবং বেঁচে যাওয়াদের জন্য একটি ইতিবাচক আভাস এবং উল্লেখযোগ্য মাইলফলক যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দ্বারা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা গণহত্যা এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, যার জন্য রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের একটি দীর্ঘ প্রত্যাশা ছিল।”

বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও বাইডেন প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন।

তিনি বেনারকে বলেন, “মার্কিন সরকারের এই ঘোষণা মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার পুনরুদ্ধার করতে এবং তাঁদের প্রত্যাবাসনকে ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করবে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যা এবং অন্যান্য অমানবিক নৃশংসতা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং সকল মানুষের জানা উচিত।”

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে বান্দরবান জেলার নো-ম্যানস ল্যান্ডে বসবাসকারী রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ বেনারকে বলেন, “মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের গণহত্যা গণহত্যার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এটি বিশ্বাস করেছিল, কিন্তু তারা এতদিন আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি।”

“এতে কোনো সন্দেহ নেই যে মার্কিন সরকার কর্তৃক গণহত্যার এই স্বীকৃতি রোহিঙ্গাদের জন্য খুবই ইতিবাচক একটি ঘটনা,” বলেন দিল মোহাম্মদ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।