পশ্চিমবঙ্গে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে বিজেপির বিরোধিতা, বিক্ষোভ
2018.03.23
কলকাতা

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের বেসরকারি উদ্যোগে পুনর্বাসনের বিরোধিতা করে আন্দোলনে নেমেছে ভারতীয় জনতা পার্টির বিভিন্ন শাখা সংগঠন।
শুক্রবার কলকাতায় ভারতীয় জনতা যুব মোর্চা ও ভারতীয় জনতা মহিলা মোর্চার উদ্যোগে অবস্থান বিক্ষোভ পালিত হয়।
“তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থনে পশ্চিমবঙ্গে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে মদত দেওয়া হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলনে নেমেছি,” বেনারকে বলেন ভারতীয় জনতা পার্টির পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সাধারণ সম্পাদিকা দেবশ্রী চৌধুরী।
তবে বিজেপির অভিযোগ খারিজ করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘দেশ বাঁচাও সামাজিক কমিটি’র প্রধান হোসেন গাজী বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গারা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন। আমরা তাঁদের আশ্রয় দিয়েছি। সাধারণ মানুষ এগিয়ে এসে সাহায্য করছে। বর্তমানে রাজ্যের ৪২টি সংগঠন এদের পুনর্বাসনের কাজে সহযোগিতা করছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারকেও আমরা চিঠি লিখে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছি।”
তিনি বলেন, পশ্চিমবঙ্গে যে সব রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন তাঁরা সকলেই অনেক আগে ভারতে এসে দিল্লি, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, জম্মু ও কাশ্মীরে থাকছিলেন। নিরাপদ মনে করেই তাঁরা পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন। এদের সকলের কাছে জাতিসংঘের দেওয়া শরণার্থী পরিচয়পত্র রয়েছে।”
বেসরকারি উদ্যোগে রোহিঙ্গা শিবির
পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার বারুইপুরের হাড়দহ গ্রামে সম্পূর্ণ বেসরকারিভাবে স্থানীয় সমাজসেবী হোসেন গাজীর উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় রোহিঙ্গা শিবির। এই শিবিরে গত কয়েকমাসে প্রায় ১৫০ জন রোহিঙ্গা এসে আশ্রয় নিয়েছেন। এদের অধিকাংশ নারী ও শিশু। আরও অনেক রোহিঙ্গা নানাদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকছেন বলে জানান হোসেন গাজী।
মানবিক কারণেই নিজের ১৫ কাঠা জমিতে রোহিঙ্গাদের থাকার ব্যবস্থা করেছেন বলে জানান রোহিঙ্গা আশ্রয়দাতা হোসেন গাজী।
তিনি বেনারকে বলেন, “অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানোর স্বার্থেই এ ব্যবস্থা করেছি। এর সঙ্গে রাজনীতির কোনও সংযোগ নেই। অসৎ কোনও উদ্দেশ্যও নেই।”
এই সব রোহিঙ্গার নিরাপত্তার দাবি জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন, মুসলিম সংগঠনসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।
গোয়েন্দা সুত্রে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের সাথে যুক্ত সংগঠনগুলো নিয়মিতভাবে অর্থ সংগ্রহও শুরু করেছে।
বিষয়টি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন বলে এড়িয়ে যান।
সরকারি হিসেবে ভারতে প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছেন। এদের মধ্যে প্রায় ১৬ হাজার জাতিসংঘের শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত।
গত বছর বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের দেশটির নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে উল্লেখ করে তাঁদের চিহ্নিত করে ফেরত পাঠানোর জন্য এক নির্দেশনা জারি করে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার।
পরে দুজন শরণার্থী সুপ্রিম কোর্টে মামলা করলে সেই মামলার শুনানি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আদালত রোহিঙ্গাদের বিষয়ে সরকারি পদক্ষেপের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের রাজ্য সরকার জাতিসংঘের শরণার্থী কার্ড দেবার সিদ্ধান্ত নিলেও পরে ভারত সরকারের নির্দেশিকা পেয়ে তা স্থগিত করে দেয়।
পশ্চিমবঙ্গে এখন পর্যন্ত কতজন রোহিঙ্গা বসবাস করছেন তার সঠিক তথ্য জানা যায়নি। সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে রাজ্যটিতে শ দুয়েকের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছেন।
এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের কারা দপ্তর সুত্রে জানা গেছে, অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে রাজ্যের বিভিন্ন জেলে প্রায় ৮৩ জন রোহিঙ্গা রয়েছেন। এছাড়া হোমগুলিতে রযেছে ২৪ জন শিশু।
পশ্চিমবঙ্গে থাকা রোহিঙ্গাদের কাছে জাতিসংঘের দেওয়া শরণার্থী পরিচয় পত্র রয়েছে বলে জানিয়েছে দক্ষিণ ২৪ জেলার বারুইপুর থানার পুলিশ।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচ্চপদস্থ এক আধিকারিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সুনির্দিষ্ট নির্দেশ পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে সরকার।
তবে নিয়মিত এই রোহিঙ্গাদের বিষয়ে খোঁজখবর করে প্রশাসনের কাছে রিপোর্ট পাঠানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জেলা পুলিশ সুপার অরিজিৎ সিংহ।
এলাকার মানুষ রোহিঙ্গাদের পাশে
গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ ৮টি রোহিঙ্গা পরিবারের ২৯ জন প্রথম হাড়দহে এসে আশ্রয় নেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি আসেন ২২ জন। তৃতীয় পর্যায়ে ৫৩ জন আসেন ১৭ ফেব্রুয়ারি। এরপর ১০ মার্চ আসেন ৫ জন। গত ১৩ মার্চ ৮০ জনের একটি দল দক্ষিণ ২৪ পরগণায় এসেছেন। তবে এরা শিবিরে না থেকে জেলার বিভিন্ন জায়গায় থাকছেন।
গ্রামের মানুষ এই সব রোহিঙ্গাদের সাদরে বরণ করে নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন সারা বাংলা সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান।
তিনি বেনারকে বলেন, “প্রায় দু’মাস গ্রামের মানুষ নিজেরা জামা কাপড় থেকে শুরু করে খাবার দাবার দিয়ে সাহায্য করেছেন। এমনকি রোহিঙ্গা ছেলেমেয়েদের স্থানীয় মাদ্রাসায় লেখাপড়ারও ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।”
শিবিরে আশ্রয় নেওয়া মুহম্মদ শহীদুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “আমাদের যেভাবে গ্রামের মানুষ সাহায্য করছেন তা ভুলে যাওয়ার নয়। তারাই আমাদের বেঁচে থাকার জন্য কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।”
গত ১৫ মার্চ পুলিশ রোহিঙ্গাদের তুলে নিয়ে যেতে চাইলে গ্রামবাসীরাই প্রতিহত করেছেন বলে জানান তিনি।
বিজেপির অভিযোগ
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম থেকেই রোহিঙ্গা নিয়ে ভারত সরকারের নীতির সমালোচনা করছেন। তিনি রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিশীল বলেও জানিয়েছেন। গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর মুখ্যমন্ত্রী টুইটারে লিখেছেন, রোহিঙ্গাদের সাহায্য করার ব্যাপারে জাতিসংঘের আবেদনকে সমর্থন জানাচ্ছি। সব রোহিঙ্গাই সন্ত্রাসবাদী নয়।
তবে রোহিঙ্গা আশ্রয়ের বিষয়টি কখনই মানবে না জানিয়ে সোমবার কলকাতার বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে প্রয়োজনে বৃহত্তর প্রতিবাদ আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছে বিজেপি।
“পশ্চিমবঙ্গ এমনিতেই আশ্রয়হীনদের তালিকায় দ্বিতীয় রাজ্য। সেখানে নতুন করে আশ্রয়হীনদের জায়গা দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে ভারত সরকারের হস্তক্ষেপ দাবি করছি,” বলেন দেবশ্রী চৌধুরী।
নিরাপত্তার দাবি
সারা বাংলা সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মহম্মদ কামরুজ্জামান বেনারকে বলেন, “যতদিন পর্যন্ত না মিয়ানমারে এদের ফিরে যাবার পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে ততদিন এসব শরণার্থী যাতে এখানে থাকতে পারেন সেটা রাজ্য সরকার দেখবেন বলে আশা করি।”
“শরণার্থী এবং তাঁদের যারা সাহায্য করছে পুলিশ প্রশাসন তাদের নিয়মিত নির্যাতন করছে, তাদের তুলে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে,” জানান তিনি।
গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা কমিটি মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা এক খোলা চিঠিতে পশ্চিমবঙ্গে আগত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বসবাসের উপযুক্ত আশ্রয় শিবিরের ব্যবস্থা করে দিতে বলেছে।
কমিটির সাধারণ সম্পাদক ধীরাজ সেনগুপ্ত বলেন, “রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে ভারত সরকার অমানবিক ও মুসলিম বিদ্বেষ প্রসূত নীতি নিয়েছে। এই অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ নেবে বলে আশা করি।”