রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশকে পূর্ণ সমর্থনের প্রতিশ্রুতি ভারতের
2018.04.09
ঢাকা

প্রত্যাবাসনসহ রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগকে পূর্ণ সমর্থন দেওয়ার কথা জানিয়েছে প্রতিবেশী ভারত। সোমবার পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হকের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর সাংবাদিকদের এ সমর্থনের কথা জানান ঢাকা সফররত ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিজয় কেশব গোখলে।
“রাখাইন থেকে বাস্তুচ্যুত জনগণের জন্য বাংলাদেশ যা করেছে তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। যত দ্রুত সম্ভব এদের প্রত্যাবাসনসহ এ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগকে পূর্ণ সমর্থন দেবে ভারত,” বলেন তিনি।
কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য দ্বিতীয় ধাপে মানবিক সহায়তা পাঠানোরও ঘোষণা দেন বিজয় গোখলে। যার আওতায় রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্য সেবার বিভিন্ন সরঞ্জামের সঙ্গে গুঁড়ো দুধ, শিশুখাদ্য, শুকনো মাছ, রান্নার চুলা ও জ্বালানি, রেইনকোট এবং গামবুটও থাকবে বলে জানান তিনি।
এর আগে গত সেপ্টেম্বরে তিন লাখ শরণার্থীর জন্য ত্রাণ সহায়তা পাঠিয়েছিল ভারত।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের এই অবস্থানে সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক।
“রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে ভারতের যে অবস্থান, বিশেষ করে তারা যে এই সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়, তাতে আমরা অত্যন্ত খুশি,” সাংবাদিকদের বলেন তিনি।
কিছুদিন আগেও ‘নিঃশর্তভাবে’ মিয়ানমারকে সমর্থন দিয়ে যাওয়া ভারতের এ অবস্থান পরিবর্তনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “পররাষ্ট্রসচিবের এই সফরের আগে থেকেই লক্ষ করা যাচ্ছিল, ভারত শুরুতে মিয়ানমারকে যেভাবে শর্তহীনভাবে সমর্থন করে আসছিল, সেই মাত্রা কমে আসছে। সে ক্ষেত্রে ভারত ইতিমধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু ফলাফল কিছু হয়নি। কারণ আসল বিষয়টা মিয়ানমারের।”
“মিয়ানমার যদি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে আন্তরিক না হয়, তাহলে ভারত বা অন্য কোনো দেশের বড় ভূমিকা পালনের সুযোগ নেই। তবে ভারত মিয়ানমারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা যে নেই, তার ওপর কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে পারে। সেদিক থেকে বাংলাদেশের একটা প্রত্যাশার সুযোগ তৈরি হয়েছে,” মনে করেন তিনি।
আলোচনায় তিস্তা, বাংলাদেশ সন্তুষ্ট
সোমবার সকাল থেকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় অনুষ্ঠিত কয়েক ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে দু’দেশের মধ্যে অমীমাংসিত তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তিসহ দ্বিপক্ষীয় সকল বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলেও জানান শহীদুল হক।
বৈঠকের ফলাফল নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে এক যৌথ বিবৃতিতে শহীদুল হক বলেন, “ভারত যত শিগগির সম্ভব তিস্তা চুক্তির সমাধানে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে, এতে আমি অত্যন্ত খুশি।”
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এবং তিস্তা চুক্তির অগ্রগতির কথা উল্লেখ করে এই সমস্যাটি (তিস্তা চুক্তি) সমাধানে তাঁরা কঠোর পরিশ্রম করছেন বলে জানান ভারতের পররাষ্ট্রসচিব।
তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. দেলোয়ার বলছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরের সময় দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর মেয়াদেই তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তাঁর মেয়াদ কমে আসছে এবং আগামী বছর দেশটিতে নির্বাচন। তার আগে একটা কিছু প্রোডিউস করার চাপ ভারতের ওপর আছে। সে দিক থেকে তিস্তা চুক্তির বিষয়ে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ আছে।
তিনি বেনারকে বলেন, “মমতা ব্যানার্জীও কতকাল দ্বিপক্ষীয় একটা সম্পর্কের ব্যাপারে কাঁটা হয়ে থাকবেন সেটাও দেখার বিষয় আছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে হয়তো এ চুক্তির বিষয়ে সক্রিয় বিবেচনা বা সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে।"
ড. দেলোয়ারের মতে, “নরেন্দ্র মোদীর মেয়াদ যেমন শেষ হয়ে আসছে, তেমনি বাংলাদেশেরও সামনে নির্বাচন আছে। অতএব এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে একটা নাটকীয় ঘোষণা আমরা পেতে পারি, এমন আশাবাদ করা যায়।”
৬টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর
দুই পররাষ্ট্রসচিবের বৈঠকের পরে বিভিন্ন খাতে সম্পর্ক আরও জোরদার করতে দু’দেশের মধ্যে ৬টি সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষরিত হয়। এর আগে রোববার বিকেলে তিন দিনের সফরে ঢাকা পৌঁছান ভারতের পররাষ্ট্রসচিব। দায়িত্ব গ্রহণের পর এটা তাঁর প্রথম বাংলাদেশ সফর। বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় ও উন্নয়ন ইস্যু এবং প্রধান প্রধান উদ্যোগ ও সিদ্ধান্তের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনাই তাঁর সফরে উদ্দেশ্য বলে জানিয়েছে সরকারি সূত্র।
এগুলোর মধ্যে রয়েছে নুমালিগড় ও পার্বতীপুরের মধ্যে ফ্রেন্ডশিপ পাইপ লাইন প্রসার, ভারতীয় ও বাংলাদেশ বেতারের মধ্যে সহযোগিতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইসিসিআর উর্দু চেয়ার প্রতিষ্ঠা এবং জিসিএনইপি-বিএইসি ইন্টার এজেন্সি চুক্তিতে সংযুক্তি।
এ ছাড়া বাংলাদেশের ৫ শ’ বিদ্যালয়ে ল্যাঙ্গুয়েজ ল্যাব স্থাপন ও রংপুর মহানগরীর বিভিন্ন সড়কের উন্নয়ন বিষয়ক অনুদান প্রকল্পের জন্যও দুটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।
এসব সমঝোতা স্মারক বাংলাদেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, জনকল্যাণ, সড়ক অবকাঠামোসহ বিভিন্ন আর্থসামাজিক খাতের উন্নয়নে ভারতের অংশগ্রহণ প্রচেষ্টার অংশ উল্লেখ করেন বিজয় গোখলে। আর এজন্য দেশটি ১৬০০ কোটি টাকা দিচ্ছে বলেও জানান তিনি।
ভারত বাংলাদেশের পরীক্ষিত উন্নয়ন অংশীদার উল্লেখ করে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব জানান, গত সাত বছরে ভারত বাংলাদেশকে ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি ঋণ দিয়েছে। যা কোনো একক দেশকে ভারতের সবচেয়ে বেশি ঋণ দেয়ার অঙ্গীকার।
উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য এই ঋণ অত্যন্ত কার্যকর হবে বলে মন্তব্য করেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব।
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে সন্ত্রাসবাদ, উগ্রবাদ ও মৌলবাদের মতো চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় একত্রে ও অন্যান্য সমমনা দেশগুলো নিয়ে লড়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়।
যৌথ বিবৃতিতে দ্বিপক্ষীয় ক্ষেত্রে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, নিরাপত্তা, যোগাযোগ, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, নৌপরিবহন, জনগণের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের মতো খাতগুলোর অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেন দুই পররাষ্ট্রসচিব।