রোহিঙ্গা শিবিরে মিয়ানমারের মন্ত্রী, ফিরে যাবার আহ্বান জানালেন শরণার্থীদের

কামরান রেজা চৌধুরী
2018.04.11
কক্সবাজার
কুতুপালং শরণার্থী শিবির পরিদর্শনকালে রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলছেন মিয়ানমারের সমাজ কল্যাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী উইন মিয়াত আয়ে। কুতুপালং শরণার্থী শিবির পরিদর্শনকালে রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলছেন মিয়ানমারের সমাজ কল্যাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী উইন মিয়াত আয়ে। ১১ এপ্রিল ২০১৮।
কামরান রেজা চৌধুরী/বেনারনিউজ

রাখাইন থেকে প্রাণভয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কথা শুনতে এসে প্রতিবাদের মুখে পড়লেন মিয়ানমারের সমাজ কল্যাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী উইন মিয়াত আয়ে। রোহিঙ্গারা তাঁকে গণহত্যার নায়ক বলে স্লোগান দিয়ে তাঁর বিচার দাবি করেন।

বুধবার ঢাকা থেকে কক্সবাজার জেলার কুতুপালং ক্যাম্পে বিক্ষোভের এই ঘটনা ঘটে। বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশ লাঠিপেটা করে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

তবে তিনি রোহিঙ্গাদের সাথে ঘণ্টাখানেক কথা বলেন এবং তাঁদের দ্রুত রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দেন।

মিয়ানমারের এই মন্ত্রী জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা, আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংগঠন ও অন্যান্য সংস্থার প্রতিনিধিদের সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন।

শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম কুতুপালং পুলিশ ক্যাম্পের কাছের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় পাওয়ার পয়েন্টে রোহিঙ্গাদের অবস্থা সম্পর্কে মিয়ানমার মন্ত্রীর নেতৃত্বে আসা ১২-সদস্যের প্রতিনিধি দলকে অবহিত করেন।

রোহিঙ্গাদের সাথে সভা শেষে মন্ত্রী আয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “এখানে আমাদের লোকদের সহায়তা দেওয়ার জন্য আমি বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করি। সভাটি খুবই ফলপ্রসূ হয়েছে। এখানকার অবস্থা সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। সবচে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া যত দ্রুত সম্ভব শুরু করা।”

মন্ত্রীর সাথে ওই সভায় প্রায় ৩০ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু অংশ নেয়। তিনি রোহিঙ্গাদের কয়েকজনের কাছে গিয়ে তাঁদের সাথে কথা বলেন ও তাঁদের সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন।

সভা শেষে পাঁচ বছরের ছেলে আব্দুল হক ও তার মা মিনারা বেগমের কাছে যান আয়ে। তিনি হকের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই সে কেঁদে ওঠে। তার মা মিনারাও কাঁদতে থাকে।

পাঁচ সন্তানের জননী মিনারা বেনারকে বলেন, “আমার স্বামী ইউসুফকে জবাই করা হয়েছে।”

মিয়ানমারের সরকার গঠিত রাখাইনে মানবিক সহায়তা, পুনর্বাসন ও উন্নয়নের প্রধান সমন্বয়ক ড. অং রান থেট অধিকাংশ সময়ই তাঁর সরকারের অবস্থান নিয়ে বার্মীজ ভাষায় কথা বলেন।

“তাঁরা বলেছেন, আরাকানে গিয়ে আমাদের ক্যাম্পে থাকতে হবে। ক্যাম্পে থাকলে ওপারে যাব কেন? আমরা আমাদের বাড়িঘরে ফিরে যেতে চাই,” রোহিঙ্গা শরণার্থী জাহিদ হোসেন বেনারকে বলেন।

তিনি বলেন, “আমরা জাতীয় যাচাই কার্ড নেব না। আমরা আমাদের নাগরিকত্ব চাই।”

তাসলিমা নামের আরেক রোহিঙ্গা নারী বেনারকে বলেন, “উনি তো আমাদের কোনো কথা শুনলেন না। উনি তাঁদের মত বলে গেলেন। এরকম সফরের কী দরকার?”

 

জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠনের সাথে সভা

দুদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে বুধবার প্রথম প্রহরে ঢাকায় অবতরণ করেন মন্ত্রী আয়ের নেতৃত্বে ১২-সদস্যের মিয়ানমার প্রতিনিধিদল।

বুধবার সকাল দশটায় তাঁরা ঢাকা থেকে কক্সবাজার পৌঁছান। সাড়ে দশটার দিকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে মন্ত্রী উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে পৌঁছান। প্রথমে তারা জাতিসংঘ অঙ্গ সংগঠনের প্রতিনিধিদের সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন।

শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম সভায় রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের অবস্থা তুলে ধরেন।

জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠকে মন্ত্রী আয়ে খুব কম কথা বলেছেন। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে রাখাইনে মানবিক সহায়তা, পুনর্বাসন ও উন্নয়ন সেলের প্রধান সমন্বয়ক ড. অং রান থেট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন। ওই সভায় সাংবাদিকদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।

ড. অং রান থেট রোহিঙ্গা বা শরণার্থী শব্দ উচ্চারণ না করে সভায় বলেন, প্রত্যাবাসনকারীদের ফিরিয়ে নেওয়াই বড় কথা নয়। তাঁদের প্রত্যাবাসন টেকসই করতে তাঁদের জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করছে মিয়ানমার সরকার।

তিনি বলেন, শরণার্থীদের রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকার কী ব্যবস্থা নিচ্ছে সে ব্যাপারে রোহিঙ্গাদের অবহিত করতে মন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এসেছেন।

ড. থেট বলেন, প্রত্যাবাসনকারীদের কোনো ক্যাম্পে রাখা হবে না। তাঁদের অভ্যর্থনা কেন্দ্র থেকে আরেক স্থানে সরিয়ে নেওয়া হবে।

তিনি বলেন, জাতীয় যাচাই কার্ড সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে। তাঁর মতে বিশ্বের সব দেশেই নাগরিকত্ব পেতে কিছু প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই যেতে হয়। কেউ এসেই নাগরিকত্ব দাবি করতে পারে না।

মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মঞ্জুরুল করিম খান চৌধুরী বেনারকে বলেন, জাতীয় যাচাই কার্ড হলো মিয়ানমার সরকারের দেওয়া কার্ড। এই কার্ডের কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। এই কার্ড পাওয়ার পর নাগরিকত্বের আবেদন করতে হয়।

“তারা জাতীয় যাচাই কার্ড নিতে চায় না। তারা চায় নাগরিকত্ব। কারণ, তাদের পূর্বপুরুষেরা মিয়ানমারের নাগরিক ছিল। এই কার্ড নিলে তাদের ঐতিহাসিক দাবি ছেড়ে দেওয়া হয় বলে তারা মনে করে,” বলেন রাষ্ট্রদূত চৌধুরী।

সফরের প্রতিবাদে বিক্ষোভ

জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠকের পর মন্ত্রী আয়েকে কুতুপালং ক্যাম্পের আরেকটি হলে নিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ কিছু রোহিঙ্গা নরনারী ব্যানার নিয়ে ওই সফরের প্রতিবাদ জানাতে থাকে।

তারা রাস্তার পাশে ব্যানার নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে বিচার চাই বিচার চাই বলে স্লোগান দিতে থাকে। তারা মন্ত্রী আয়েকে রোহিঙ্গাদের গণহত্যার নায়ক হিসেবে চিহ্নিত করে স্লোগান দেয়।

বেনার প্রতিনিধি পুরো ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন।

কর্তব্যরত পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের বিক্ষোভ শেষ করে ফিরে যেতে বলে। তবে তারা আরও স্লোগান দিতে থাকে। ছোট ছোট শিশুরাও বিচার চাই বিচার চাই বলে স্লোগান দিতে থাকে।

পুলিশের এক কর্মকর্তা এক রোহিঙ্গাকে গালি দিলে সে ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশকে গালাগালি করতে থাকে ও গণহত্যার সহায়তাকারী বলে চিৎকার করতে থাকে। আরেক রোহিঙ্গা যুবক পুরো ঘটনাটি তার স্মার্টফোনে ভিডিও করতে থাকে।

বিষয়টি টের পেয়ে উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল খায়ের ফোনটি কেড়ে নেওয়ার সাথে সাথে ওই যুবকসহ এক নারী ‍ও অন্যান্যরা তার ওপর চড়াও হয়ে মোবাইলটি কেড়ে নিতে ধস্তাধস্তি শুরু করে।

একপর্যায়ে আনসার বাহিনীর এক সদস্য লাঠি চার্জ শুরু করে। এরপর রোহিঙ্গারাও পুলিশের ওপর আক্রমণ করে। রোহিঙ্গাদের ছোড়া একটি ঢিল এক পুলিশ সদস্যের মাথায় লাগে। এরপর পুলিশ বাঁশি বাজিয়ে লাঠি চার্জ করে রোহিঙ্গাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে র‍্যাবসহ বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করলে রোহিঙ্গারা সরে যায়।

মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মঞ্জুরুল করিম খান চৌধুরী বেনারকে বলেন, “মন্ত্রী আয়ে ও তার সফর সঙ্গীরা রাতে হোটেল টিউলিপে অবস্থান করবেন ও আগামী কাল ঢাকা ফিরবেন। বৃহস্পতিবার মিয়ানমার মন্ত্রী পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করবেন।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।