পাঁচ রোহিঙ্গার ফিরে যাওয়া প্রত্যাবাসন নয়: বাংলাদেশ
2018.04.16
ঢাকা
মিয়ানমারের তুমব্রু সীমান্ত এলাকার শূন্যরেখায় বসবাসকারী পাঁচ রোহিঙ্গার রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাওয়াকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও এটাকে প্রত্যাবাসন বলছেন না বাংলাদেশ কর্মকর্তারা।
শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম সোমবার বেনারকে বলেন, ওই পাঁচ রোহিঙ্গার রাখাইন ফিরে যাওয়া কোনোভাবেই প্রত্যাবাসন নয়।
তবে তিনি মনে করেন, তাঁদের ফিরে যাওয়া প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে পারে।
রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রিত দি গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমার জানিয়েছে, শনিবার রাতে বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্তের জিরো লাইনে মিয়ানমার অংশে বসবাসকারী রোহিঙ্গা এখতার আলম তাঁর পরিবার নিয়ে রাখাইনের টং পিয়ো লিটওয়ে অভ্যর্থনা কেন্দ্রে হাজির হলে মিয়ানমার সরকারের কর্মকর্তারা তাঁদের গ্রহণ করে।
পত্রিকাটি এখতার আলম ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের জাতীয় ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) গ্রহণের ছবি প্রকাশ করেছে।
আলমের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী সাজেদা বেগম (৪২), মেয়ে সাহেনা বেগম (১৩), ছেলে তারেক আজিজ (৭) এবং গৃহকর্মী শওকত আরা বেগম (২৩) রয়েছেন।
শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বেনারকে বলেন, শনিবার রাতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের তুমব্রু শূন্যরেখায় অবস্থান করা পাঁচজন মিয়ানমারে ফেরত গেছে বলে প্রচার হয়েছে।
তিনি বলেন, “তারা শূন্যরেখার মিয়ানমার অংশে বসবাস করত। তারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গেছে। তারা তাদের দেশে আসা-যাওয়া করতেই পারে। তাই এটি কোনো ভাবেই প্রত্যাবাসন পর্যায়ে পড়ে না।”
আবুল কালাম বলেন, তুমব্রু সীমান্ত এলাকার শূন্যরেখায় প্রায় ৬ হাজার রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। তারা বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করেনি।
“শূন্যরেখায় বসবাসকারী রোহিঙ্গা মানুষগুলো যদি তাদের দেশে চলে যায় বা তাদের সরকার তাদের নিয়ে যায়, তবে তা হবে খুবই ইতিবাচক ব্যাপার। আর এই প্রক্রিয়া পুরো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে সহজ করতে পারে,” বলেন আবুল কালাম।
গত বছর আগস্টে রাখাইনে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সন্ত্রাসী হামলার পর শুরু হওয়া সামরিক অভিযানে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
কিন্তু প্রায় ছয় হাজার রোহিঙ্গা সীমান্তের মিয়ানমার অংশে থেকে যায়। তাদের বাংলাদেশে প্রবেশ করতে বাধ্য করতে মিয়ানমার সেনারা রাতে তাদের ওপর প্রায়ই ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করত। তবে ওই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসতে অস্বীকৃতি জানায়।
ফেব্রুয়ারি মাসে মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সময় সীমান্তের জিরো লাইনে বসবাসকারী ছয় হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর দুই দেশের জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে বৈঠকও করেন। তবে তাদের কিউকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়নি।
যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের দ্বিতীয় সভা ৩০ এপ্রিল
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বেনারকে বলেন, জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের দ্বিতীয় সভা আগামী ৩০ এপ্রিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। তিনি সেই সভায় উপস্থিত থাকবেন।
তিনি বলেন, “সেই সভায় সীমান্তের শূণ্যরেখায় বসবাসকারী ছয় হাজার মানুষসহ বাংলাদেশে অবস্থানকারী মিয়ানমার নাগরিকদের প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা হবে। আমাদের দেওয়া ৮,০৩২ জনের তালিকা থেকে এখন পর্যন্ত ৭০০ জনের মতো মানুষকে মিয়ানমার সরকার প্রত্যাবাসনের জন্য ভ্যারিফাই করেছে।”
তিনি বলেন, এই সংখ্যা প্রথম তালিকার শতকরা দশ জনেরও কম।
আবুল কালাম বলেন, আগামী যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি বলেন, এমাসের শেষের দিকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরে আসবে। তাঁরা ক্যাম্প সফর করবে বলে আমরা জেনেছি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন পরিচালক বেনারকে বলেন, জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভা ৩০ এপ্রিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। তবে একই সময়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রতিনিধিদল ২৯ এপ্রিল ঢাকায় আসার কথা রয়েছে।
তাঁরা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাথে কথা বলবেন।
তিনি বলেন, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সদস্যদের সফরকে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে। যদি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভার সময় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা সফরে আসেন, তবে সে ক্ষেত্রে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভা পিছিয়ে দেওয়া হতে পারে।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার গত ২৩ নভেম্বর ১৯৯২ সালের চুক্তির আলোকে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তি অনুযায়ী, জানুয়ারি ২২ তারিখের মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরু করার কথা ছিল।
চুক্তির আলোকে দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবের নেতৃত্বে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠিত হয়। জানুয়ারি ১৬ তারিখে গ্রুপের প্রথম সভায় দুই দেশ ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট চুক্তি স্বাক্ষর করে।
কিন্তু কোনো রোহিঙ্গাকে দেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।
এনভিসি বিতর্ক
মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের শর্ত হিসেবে জাতীয় ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) নিতে বলছে। তবে, রোহিঙ্গারা তা নিতে নারাজ বলে বেনারকে জানিয়েছেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি-ব্লক নেতা জাহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, মিয়ানমারের নাগরিকত্ব পেতে হলে কোনো বিদেশিকে প্রথমে এনভিসি নিতে হয়। এরপর তাঁরা সিদ্ধান্ত নেয় যে তাঁকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে কি না।
“আমরা কি বিদেশি? আমাদের বাপ-দাদারা শত শত বছর ধরে আরাকানে বসবাস করেছে। এখন যদি আমাদের বিদেশি বলে এনভিসি নিতে বলা হয় তাহলে কি ঠিক হবে?,” বলেন জাহিদ।
তিনি বলেন, “এখতার আলমকে এনভিসি দিয়ে তাঁরা এখন বিদেশিদের বলবে যে রোহিঙ্গারা এনভিসি নিতে রাজি হয়েছে। আমরা এনভিসি নেব না। আমাদের বাপ-দাদার অধিকার ছাড়ব না।”
ওই জিরো পয়েন্টের রোহিঙ্গা মাঝি দিল মোহাম্মদ জানান, এখতার আলম মিয়ানমারের মংডু জেলার বলিবাজারের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি গোপনে মিয়ানমার সরকারের সাথে যোগাযোগ করে রাতের আঁধারে সবার অজান্তে নিজ দেশে পাড়ি দেন।
তিনি বলেন, তাঁর ফিরে যাওয়া পুরো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করবে।
টেকনাফ থেকে প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন আবদুর রহমান।