সাজার মেয়াদ শেষেও মুক্তি পায়নি ১৪ মিয়ানমার নাগরিক

কামরান রেজা চৌধুরী
2018.04.19
ঢাকা
মিয়ানমারের নাগরিকদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে টেকনাফে নাফ নদীর তীরে বিজিবির পাহারা। মিয়ানমারের নাগরিকদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে টেকনাফে নাফ নদীর তীরে বিজিবির পাহারা। ১৪ জুন ২০১২।
এপি

সাজার মেয়াদ শেষ করার পরও বিনা অপরাধে জেলের ঘানি টেনে যাচ্ছেন নয় রোহিঙ্গাসহ মিয়ানমারের ১৪ নাগরিক। এদের মধ্যে কেউ কেউ এক বছর থেকে দেড় যুগ পর্যন্ত বিনা অপরাধে কক্সবাজার জেলা কারাগারে রয়েছেন।

কারা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সাজার মেয়াদ শেষ করা নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে কোনও আগ্রহ নেই মিয়ানমার সরকারের। তাই তাঁদের নিয়ে বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী কোনও বিদেশি তাঁর সাজা শেষ করলে সংশ্লিষ্ট দেশে ফেরত পাঠানো হয়।

“তাঁদের মুক্তি দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এখন আমরা সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়,” বৃহস্পতিবার বেনারকে জানান কক্সবাজার জেলা কারাগারের তত্ত্বাবধয়াক বজলুর রশিদ আকন্দ।

আকন্দ বেনারকে বলেন, বর্তমানে কক্সবাজার জেলা কারাগারে মোট তিন হাজার ১৯ জন বন্দীর মধ্যে ৪৮৯ জন রোহিঙ্গা রয়েছে। তাঁদের মধ্যে ১৪ জন রোহিঙ্গা সাজার মেয়াদ শেষ করেছে অনেক আগেই। অধিকাংশের বিরুদ্ধেই পাসপোর্ট আইনে অনুপ্রবেশের মামলা ছিল।

“আমরা তাঁদের মুক্তির জন্য কারা অধিদপ্তরের মাধ্যমে গত বছর নভেম্বর মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফাইল পাঠিয়েছি। তবে মন্ত্রণালয় থেকে এখনো কোনও নির্দেশ পাইনি,” বলেন আকন্দ।

তিনি বলেন, যেহেতু মিয়ানমারে আমরা তাঁদের প্রত্যাবাসিত করতে পারছি না সেহেতু তাঁদের শরণার্থীশিবিরে পাঠানো হতে পারে।

আকন্দ বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পেলেই আমার তাঁদের শরণার্থীশিবিরে পাঠানোর ব্যবস্থা করব। তিনি বলেন, এর আগে হাইকোর্টর নির্দেশ মোতাবেক সাজার মেয়াদ শেষ করা দুজন রোহিঙ্গাকে আমরা শরণার্থীশিবিরে পাঠিয়েছি।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মুনিম হাসান বেনারকে বলেন, আমরা জেনেছি যে ওই ১৪ রোহিঙ্গা সাজা শেষ করার পরও কারাগারে আছে। এটি অমানবিক। ফাইল দেখে যত দ্রুত সম্ভব তাঁদের মুক্তির ব্যবস্থা করা হবে।

তিনি বলেন, তাঁদের মানবাধিকার রক্ষায় সরকার সচেষ্ট।

মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত অনুপ কুমার চাকমা বেনারকে বলেন, রোহিঙ্গারা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। তাঁদের খুব কমই ধরা পড়ে।

আবার যারা রাখাইন ছেড়ে যায় বা আটক হয় তাদের ফিরিয়ে নিতে খুব বেশি আগ্রহ দেখায় না মিয়ানমার সরকার, জানান তিনি।

তাই, তাঁদের প্রত্যাবাসন খুবই কঠিন কাজ, বলেন অনুপ চাকমা।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, সাজার মেয়াদ শেষ করা বিদেশি নাগরিকদের যদি সংশ্লিষ্ট দেশ নিতে অস্বীকৃতি জানায়, তাহলে যেদেশে সে জেল খেটেছে সেই দেশ নাগরিকত্ব দিতে পারে অথবা তৃতীয় কোনো দেশে তাঁদের পাঠানো যেতে পারে।”

সাজা শেষ করেও ১৭ বছর জেলে

কারা তত্ত্বাবধায়ক আকন্দ বলেন, ২০০০ সালের ৫ অক্টোবর নাফ নদী পেরিয়ে টেকনাফ দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেন মিয়ানমারের মংডুর আকিয়াবের মাইদি এলাকার আবুল হোসেনের ছেলে রোহিঙ্গা হাফেজ আহমেদ (৩৫)।

তাঁর বিরুদ্ধে বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে পাসপোর্ট আইনে মামলা হয়। ১০ মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয় হাফেজ আহমেদকে। এরপর থেকেই কারাগারে আছেন তিনি।

২০০১ সালের ১৮ জুলাই তাঁর সাজার মেয়াদ শেষ হয়। কিন্তু তিনি কারাগারে রয়েছেন আরো বাড়তি ১৬ বছর ৮ মাসের বেশি সময়। এখন হাফেজের বয়স ৫৩ বছর।

কারা সূত্রের তথ্যমতে, ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরে মংডুর ফকিরাবাজার এলাকার মৃত ইউছুফ আলীর ছেলে আলী আকবরকে (২৮) কক্সবাজার কারাগারে নেওয়া হয়। তাঁর সাজার মেয়াদ শেষ হয় ২০০৫ সালের মার্চে। তারপর কারাগারে কেটে গেছে আরও ১৩ বছর। এখনো রয়েছেন কারাগারে।

২০০২ সালের সেপ্টেম্বরে কারাগারে বন্দী হন মংডুর আকিয়াবের বদলাপাড়ার খলিলুর রহমানের ছেলে আবদুর রহিম (৩৮)। কারাভোগ শেষ হয় ২০০৬ সালের জুলাই মাসে। এখন তাঁর বয়স ৫০ বছর। এখনো তিনি বন্দী জীবন কাটাচ্ছেন।

আরেক কারাবন্দী বুছিডংয়ের জব্বারপাড়ার মোহাম্মদ ইউনুছের ছেলে মো. সেলিমকে (৩২) অস্ত্র মামলায় কারাগারে পাঠানো হয় ২০০১ সালের নভেম্বরে। তাঁর সাজা শেষ হয় ২০১১ সালের মে মাসে।

সাজা শেষ হওয়ার পর তিনি কারাগারে আছেন বাড়তি সাত বছর ধরে।

২০০৭ সালের মে মাসে একই এলাকার সাব্বির রহমানের ছেলে মুহাম্মদ রফিক (৩০) কারাবন্দী হন। সাজা শেষ করেছেন ২০১১ সালের জুলাই মাসে। ইতিমধ্যে কারাগারে কেটে গেছে বাড়তি আরও সাত বছর।

পোকখালীর হাবিব উল্লাহর ছেলে বশির আহমদ (২৯) ২০১০ সালের জানুয়ারিতে কারাগারে আসেন। সাজার মেয়াদ শেষ করেন ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে। কিন্তু মুক্তি মেলেনি।

আকিয়াব বলিবাজার এলাকার বসরের ছেলে নুরুল আমিনকে (২৪) ২০০৯ সালে কারাগারে পাঠানো হয়। সাজা শেষ হয় ২০১৪ সালে।

বুছিডংয়ের হ্নীলা এলাকার মৃত মুজিবুরের ছেলে রাসেল (৪৫) ২০০৬ সালের অক্টোবরে কারারুদ্ধ হন। সাজার মেয়াদ শেষ করেন ২০১৩ সালের ডিসেম্বর।

একই এলাকার ইয়ং চয়ং পাড়ার আবদুস শুক্কুরের স্ত্রী খতিজার (৫০) কারাদণ্ডের মেয়াদ ছিল ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর।

২০১৭ সালের মে মাসে কারাগারে গিয়ে একই বছরের জুলাই মাসে সাজাভোগ শেষ করেন মংডুর তাতুইং গ্রামের মৃত মংচিং মারমার ছেলে আবুচিং মারমা (২২)।

রাখাইন রাজ্যের মমবা গ্রামের ওমারিন মিউ মারমার ছেলে হিং থাই নাই মারমা (২৪) ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে কারারুদ্ধ হন। সাজার মেয়াদ শেষ হয় গত বছরের নভেম্বরে।

মিয়ানমারের বুচিদং মায়ুকং ওরফে মং কং মারমার ছেলে নিতওয়া (৫০) ২০১৩ সালের নভেম্বর কারারুদ্ধ হয়ে ২০১৭ সালের জুনে সাজা শেষ করেন।

২০১২ সালের জানুয়ারি সাজার মেয়াদ শেষ করেন চউইং রাখাইনের ছেলে চিং অং রাখাইন।

পলোয়া খায়ংপল্লীর মৃত লেচং এর ছেলে হেইটং (৪৫) ২০০৮ সালের আগস্ট মাসে কারারুদ্ধ হন। তিনিও সাজার মেয়াদ শেষ করেছেন। কিন্তু মুক্তি মেলেনি।

ড. মিজানুর রহমান বলেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের উচিত মিয়ানমারের মানবাধিকার কমিশনের কাছে বিষয়গুলো তুলে ধরা। এর মাধ্যমে হয়তো সমস্যাটির সুরাহা হতে পারে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।