মালয়েশিয়া থেকে ফিরিয়ে দেওয়া রোহিঙ্গাদের ট্রলার সমুদ্রে ভাসছে
2020.04.22
ঢাকা ও কক্সবাজার

মালয়েশিয়া থেকে তাড়িয়ে দেওয়া আনুমানিক পাঁচশ রোহিঙ্গা নারী–পুরুষ ও শিশু বহনকারী দুটি মাছধরা ট্রলার বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। এমন তথ্য উল্লেখ করে বুধবার এক বিবৃতিতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, ট্রলার দুটি বাংলাদেশের দিকে যাচ্ছিল।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এই সংস্থাটি মনে করে, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের উচিত সমুদ্রে ভাসমান এসব শরণার্থীকে উদ্ধার করে আশ্রয় দেওয়া। সংস্থাটি বলেছে, পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন গভীর সমুদ্রে আরও একটি জাহাজ থাকতে পারে, যেখানে আরও কয়েকশ রোহিঙ্গা আটকা পড়ে আছেন।
বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মো. মাহবুব আলম তালুকদার বেনারকে বলেন, “আদৌ কোনো রোহিঙ্গা শরণার্থী বা আশ্রয়প্রার্থী সমুদ্রে অবস্থান করছে কিনা সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। আমার কাছে এ রকম তথ্য নেই।”
“আমার ভূমিকা হচ্ছে বাংলাদেশে বা আমাদের শরণার্থী ক্যাম্পগুলোয় কেউ চলে এলে তাঁদের মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করা। শেষ পর্যন্ত যদি কেউ এখানে পৌঁছে যায়, আমাদের পক্ষ থেকে অবশ্যই তাঁদের যত্ন নেওয়া হবে,” বলেন তিনি।
“নৌকাগুলো দূরে ঠেলে দিতে সক্রিয় দেশগুলোর সরকারের নিষ্ঠুর উদাসীনতার বিপরীতে বাংলাদেশ বাস্তুচ্যুত ও ভয়াবহ নিপীড়নের শিকার হওয়া শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রেখেছে,” বিবৃতিতে বলেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক বিরাজ পাটনায়ক।
“আমরা আশা করি এই কঠিন সময়েও বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বাগত জানাবে,” তিনি বলেন।
তাঁর মতে, “এই পরিস্থিতি ২০১৫ আন্দামান সমুদ্র সংকটের স্মৃতি জাগ্রত করে, যখন অগণিত সংখ্যক রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয়নি এবং শতাধিক ব্যক্তি প্রাণ হারান।
উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের মে মাসে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ থেকে মানব পাচারকারীরা মালয়েশিয়ায় নেওয়ার কথা বলে প্রায় পাঁচ হাজার শরণার্থী ও অভিবাসীকে বঙ্গোপসাগর এবং আন্দামান সাগরে ফেলে চলে যায়।
বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষকে রোহিঙ্গাদের উদ্ধার ও আশ্রয় দেওয়ার কাজে সহায়তা করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বাধ্যবাধকতা রয়েছে জানিয়ে অ্যামনেস্টি বলেছে, কোয়ারেন্টাইন সেন্টার স্থাপন, উদ্ধারকৃতদের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা এবং করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা এর অন্তর্ভুক্ত।
বিরাজ পাটনায়ক বলেন, “সমুদ্র যাতে সুরক্ষার সন্ধানকারী মানুষগুলোর কবরস্থান হয়ে না যায়, সে বিষয়ে এই অঞ্চলের সমস্ত দেশের একটি দায়িত্ব রয়েছে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশকে একা ছেড়ে দেওয়া যায় না।”
গত সপ্তাহেই দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সরকারগুলোকে সমুদ্রে ভাসমান সম্ভাব্য আরও কয়েক শতাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে অনুসন্ধান ও উদ্ধারের আহবান জানিয়েছিল অ্যামনেস্টি। সংস্থাটি বলেছে, কোভিড-১৯ মহামারি সরকারগুলোর জন্য শরণার্থীদের প্রতি নিজেদের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার অজুহাত হতে পারে না।
অনুসন্ধান ও উদ্ধার প্রচেষ্টা চালানোর জন্য অন্যান্য দেশের সরকারকেও অবশ্যই যৌথ দায়িত্ব পালন করতে হবে উল্লেখ করে তাঁদের উদ্দেশ্যে সংস্থাটি বলেছে, জীবনরক্ষায় আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে সমুদ্রের শরণার্থী এবং আশ্রয়প্রার্থীদের নিরাপদে অবতরণের অনুমতি দিন।
বিজিবি ও কোস্ট গার্ড যা বলছে
স্থানীয় জেলেরা বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) এবং কোস্ট গার্ড কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন, সাগরে রোহিঙ্গা বহনকারী ট্রলার দেখতে পেয়েছেন তাঁরা।
বিজিবির টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ ফয়সল হাসান খান বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের বহনকারী ট্রলার বাংলাদেশ অভিমুখে আসছে, জেলেদের কাছ থেকে এমন খবর পাওয়ার পর সীমান্ত ও উপকূলে টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে।”
“নতুন করে কোনও রোহিঙ্গা যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সে বিষয়ে স্থানীয়দের সর্তক থাকতে বলা হয়েছে,” বলেন তিনি।
কোস্ট গার্ডের টেকনাফ স্টেশনের ইনচার্জ লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এম সোহেল রানা বেনারকে বলেন, “আমরাও রোহিঙ্গা বোঝাই ট্রলারের খবরটি শুনেছি। তবে এখন পর্যন্ত সমুদ্রে এমন কোনও ট্রলারের সন্ধান পাওয়া যায়নি।”
তিনি জানান, স্থানীয়দের অনেকে বাহারছড়ার কাছে দেখতে পেয়েছেন ট্রলারটি। আবার কেউ কেউ শাহপরীর দ্বীপের কাছে ওই ট্রলার দেখতে পাওয়ার কথা বলেছেন।
রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের এই পরিণতির জন্য মানবপাচারে সক্রিয় আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্রকে দায়ী করে অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক বিশ্লেষক আসিফ মুনীর বেনারকে বলেন, “তাঁদের চিহ্নিত বা নির্মূল করতে না পারাটা কোনো একক দেশ নয়; ইন্টারপোলসহ ইন্টারন্যাশনাল যে পুলিশিং ফোর্সগুলো আছে, তাদেরও নজরদারির ব্যর্থতা।”
“মানবপাচার মূলত একটা বহুজাতিক সমস্যা, যা সমাধানে সমন্বিত ও দীর্ঘস্থায়ী পদক্ষেপ প্রয়োজন,” উল্লেখ করেন আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সাবেক ওই কর্মকর্তা।
যেভাবে এসেছে জাহাজ দুটি
অ্যামনেস্টি জানায়, মহামারির কারণে সব ধরনের নৌ-চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করায় উল্লেখিত মাছ ধরার ট্রলার দুটি মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করতে পারেনি। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে শরণার্থীদের ভয় দেখানোর জন্য সমুদ্রে আক্রমণাত্মক সামরিক টহল শুরু করেছে তারা। থাইল্যান্ডও ক্রমবর্ধমান এই সংকট সম্পর্কে নীরব ছিল বলে উল্লেখ করে তারা।
অবৈধভাবে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া সীমান্তে পৌঁছালেও দেশটিতে প্রবেশ করতে না পেরে গত ১৫ এপ্রিল কক্সবাজারে ফিরে আসা ৩৯৬ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে কোস্ট গার্ড। ওই দলের সঙ্গে থাকা অন্তত ৩০ রোহিঙ্গা খাবার ও পানি সংকটে মারা গেছেন।
৫৮ দিন সাগরে ভাসতে থাকা ট্রলারটি প্রথমে মালয়েশিয়ান কোস্ট গার্ড আটক করে। তাঁদের কিছু খাবার, পানি ও জ্বালানী দিয়ে ফেরত পাঠায়। পরে তাঁরা মিয়ানমারে প্রবেশের চেষ্টা করলে সেদেশের নৌবাহিনীও তাঁদের বাংলাদেশের দিকে পাঠিয়ে দেয়।
পাশাপাশি, শরণার্থীদের মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে এই আশঙ্কায় ১৬ এপ্রিল আরো প্রায় ২০০ রোহিঙ্গা বোঝাই একটি নৌকাকে মালয়েশিয়ায় উঠতে দেওয়া হয়নি বলে এক বিবৃতিতে জানায় দেশটির বিমানবাহিনী।
বিবৃতিতে বলা হয়, বিমান বাহিনী মালয়েশিয়ার সমুদ্র সীমার কাছে ট্রালারটি দেখতে পেয়ে তাদের নৌবাহিনীকে জানায়। পরে নৌবাহিনীর দুটি জাহাজ সেখানে গিয়ে নৌকার আরোহীদের কিছু ‘মানবিক সাহায্য’ দিয়ে নৌকাটিকে মালয়েশিয়ার জলসীমা থেকে তাড়িয়ে দেয়।
এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে ১৩৮ জন যাত্রী নিয়ে মালয়েশিয়া যাত্রাকালে সেন্টমার্টিনের পশ্চিমে একটি ট্রলার ডুবে যাওয়ার পর ৭২ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। বাকিরা মৃত বা নিখোঁজ রয়েছেন।
এদিকে অবৈধ সামুদ্রিক অভিবাসনের কারণে কারো জীবন ও সুরক্ষা বিপন্ন হতে না দেওয়ার প্রত্যয়ে বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং মিয়ানমারকে নিয়ে গঠিত টাস্কফোর্সের কর্তব্যও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় অ্যামনেস্টির বিবৃতিতে।