সাগরে ভাসমান রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করবে না বাংলাদেশ: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

শরীফ খিয়াম
2020.04.23
ঢাকা
200423-BD-rohingya-update-1000.jpg সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যেতে ব্যর্থ হয়ে টানা ৫৮ দিন সাগরে ভেসে থাকার পর টেকনাফ উপকূলে ফিরে আসা ট্রলার থেকে উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গাদের একাংশ। ১৬ এপ্রিল ২০২০।
[আবদুর রহমান/বেনারনিউজ]

মালয়েশিয়া থেকে ফেরত পাঠানো শত শত রোহিঙ্গা শরণার্থী বহনকারী মাছ ধরা ট্রলার দুটিকে বাংলাদেশ গ্রহণ করবে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বৃহস্পতিবার রাতে বেনারকে এই তথ্য জানিয়েছেন।

রোহিঙ্গা বহনকারী দুটি মাছধরা ট্রলার বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশের চেষ্টা করছে উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেনারকে বলেন, “আমাদের নৌবাহিনী এবং কোস্টগার্ড সতর্ক অবস্থায় রয়েছে এবং তাঁদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যাতে এই নৌকাগুলো বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে।”

একইদিন জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) এক বিবৃতিতে সাগরে ভাসমান রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার আহবান জানিয়েছে। এর আগে বুধবার একই আহবান জানিয়েছিল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

মালয়েশিয়া থেকে তাড়িয়ে দেওয়া আনুমানিক পাঁচশ রোহিঙ্গা নারী–পুরুষ ও শিশু বহনকারী দুটি মাছধরা ট্রলার বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে উল্লেখ করে এক বিবৃতিতে অ্যামনেস্টি বলেছিল, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের উচিত সমুদ্রে ভাসমান এসব শরণার্থীকে উদ্ধার করে আশ্রয় দেওয়া।

“প্রতিবারই বাংলাদেশকে অন্য দেশের বোঝা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। আমরা আর কোনও রোহিঙ্গাকে প্রবেশের অনুমতি দিতে পারি না,” বেনারকে বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক, কিন্তু মিয়ানমারকে তাঁদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য সেভাবে চাপ দেওয়া হয় না। এটা দুর্ভাগ্যজনক।

বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের চট্রগ্রাম-পূর্ব জোনের স্টাফ কর্মকর্তা (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (বিএন) এম সাইফুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “আমাদের অবস্থান পরিস্কার, নতুন করে কোনও রোহিঙ্গাকে ঢুকতে দেওয়া হবে না,” সমুদ্রপথে রোহিঙ্গা বোঝাই কোনও ট্রলার বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করলে, তা প্রতিহত করা হবে।”

মালয়েশিয়ায় প্রবেশে ব্যর্থ হয়ে রোহিঙ্গা বোঝাই দুইটি ট্রলার উপকূলীয় সীমান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে, এমন খবর পাওয়ার কথা জানিয়েছেন কোস্টগার্ডের কর্মকর্তাও।

টেকনাফে বসবাসকারী রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ আলম বেনারকে বলেন, “ট্রলারে আটকে থাকা ওই রোহিঙ্গারা মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশ্যে অবৈধভাবে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে নিশ্চয়ই অন্যায় করেছে। কিন্তু এখন তারা যদি কোথাও আশ্রয় না পায়, তবে মাঝ সমুদ্রে তাদের কী অবস্থা হবে—তা ভেবে দেখা দরকার।”

অভিবাসন বিশ্লেষক ড. জালাল উদ্দিন শিকদার বেনারকে বলেন, “বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে বিভিন্ন দেশ অবৈধ অভিবাসীদের সহানুভূতি ও সহমর্মিতা দেখাচ্ছে। এক দেশ আরেক দেশকে সহযোগিতা করছে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা যদি তাদের ঢুকতে না দিয়ে ফেরত পাঠাই বা তারা সমুদ্রে ভাসমান থাকে, তবে সেটা আন্তর্জাতিক মহলে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করবে।”

“মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে তাঁদের আশ্রয় দেওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি,” যোগ করেন রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) এই জ্যেষ্ঠ গবেষক।

বৃহস্পতিবার বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়েছে, মানব পাচারকারীরা রোহিঙ্গাদের মালয়েশিয়ায় ঢোকানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছে। এখন দুটি নৌকা আন্তর্জাতিক জলসীমায় ভাসছে। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত এই সংখ্যালঘু মুসলিমরা কোনও দেশে পৌঁছতে পারবে না বলেও আশঙ্কা করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

মালয়েশিয়ার বিরোধী দলীয় নেতা ও সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বৃহস্পতিবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক লাইভ সেশনে বলেন, গত সপ্তাহে মালয়েশিয়া জলসীমা থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বহন করা একটি নৌকা ফিরিয়ে দেওয়ার খবর শুনে তিনি দুঃখিত।

গত সপ্তায় এক বিবৃতিতে মানবাধিকার সংস্থা ফর্টিফাই রাইটস মালয়েশিয়ার জলসীমা থেকে শরণার্থীদের নৌকাকে এভাবে সমুদ্রে তাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাকে “বেআইনি এবং মৃত্যুদণ্ডের’ মতো ঘটনা হিসেবে মন্তব্য করে এইরকম সিদ্ধান্ত কে বা কারা নিয়েছিলেন তা তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছে।

এদিকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে লড়াইয়ের জেরে দেশটির রাখাইন রাজ্য থেকেও ট্রলার দুটি আসতে পারে বলে ধারণা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। যদিও সেগুলো অন্য কোথাও থেকে আসার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেননি তিনি।

কোস্টগার্ড কর্মকর্তা এম সাইফুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “চলতি মাসে কারাগার থেকে ২৫ হাজার বন্দীকে মুক্তি দিয়েছে মিয়ানমার। তাদের অনেককে ট্রলারে উঠিয়ে আমাদের দিকে ঠেলে দেওয়া সম্ভাবনা রয়েছে।”

“তাই জলসীমায় কোস্ট গার্ড ও নৌবাহনীর টহল জোরদার করা হয়েছে,” বলেন তিনি।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পরপরই হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) মিয়ানমারের কারাগারগুলোকে ভয়াবহ জনবহুল এবং অস্বাস্থ্যকর উল্লেখ করে সেখান থেকে স্বল্প ঝুঁকিযুক্ত বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার আহবান জানায়। এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (ডব্লিউএইচও) এ ব্যাপারে তাদের হুঁশিয়ার করে। এরই প্রেক্ষিতে বেশকিছু বন্দীকে মুক্তি দিয়েছে মিয়ানমার। এরপর থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা বেড়ে গেছে বলে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা দাবি করছেন।

গত ১২ এপ্রিল বান্দরবানের তুমব্রু সীমান্তের ৩২ ও ৩৩ নম্বর পিলার সংলগ্ন এলাকা দিয়ে ২০-৩০ জনের একটি রোহিঙ্গা দলের অনুপ্রবেশ ঠেকিয়ে দেয়া হয়েছে বলে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডে (বিজিবি) কক্সবাজার ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আলী হায়দার আজাদ আহমদ সাংবাদিকদের জানান। তিনি জানান, গত কয়েকদিন থেকে বেশকিছু রোহিঙ্গা বান্দরবান ও কক্সবাজার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে।

এটাও এক ধরনের ‘পুশ-ইন’ উল্লেখ করে অভিবাসন বিশ্লেষক ড. জালাল বেনারকে বলেন, “মিয়ানমার আসলে খুবই সুসংগঠিত। এখনও তারা নানা উপায়ে রোহিঙ্গাদের পাঠানোর চেষ্টা করছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চাপ প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই তারা এমনটা করতে পারছে।”

কক্সবাজার থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আবদুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।