মিয়ানমারের চলমান সংঘাতে দেরি হচ্ছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন: জাতিসংঘ
2019.04.26
কক্সবাজার ও ঢাকা

রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির (এএ) মধ্যে চলমান সংঘর্ষের কারণে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দেরি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সফররত জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) প্রধান ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি।
শুক্রবার বিকেলে কক্সবাজারে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি। তাঁর সাথে ছিলেন জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয় দফতরের (ওসিএইচএ) মহাসচিব ও জরুরি ত্রাণ সমন্বয়ক মার্ক লোকক এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মহাপরিচালক এন্টোনিও ভিটোরিনো।
“গত তিন-চার মাস ধরে আরাকান আর্মির সক্রিয়তার কারণে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া একেবারেই ‘শ্লথ’ হয়ে গেছে। কারণ যেসব গ্রাম আমাদের পর্যবেক্ষণ করা দরকার, নিরাপত্তার অভাবজনিত কারণে সেখানে আমরা যেতে পারছি না,” বলেন ফিলিপ্পো।
জাতিসংঘের শীর্ষস্থানীয় তিন কর্মকর্তার নেতৃত্বে গত বুধবার ঢাকায় পৌঁছানো জাতিসংঘের ২০ সদস্যের প্রতিনিধি দল বৃহস্পতিবার কক্সবাজার আসে। শুক্রবার সকালে তাঁরা চারটি শরণার্থী শিবিরে গিয়ে রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলেন এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) বিভিন্ন খাদ্য বিতরণ কেন্দ্র ঘুরে দেখেন।
রাখাইনে ফেরার সুযোগ সামান্য
বিকেলে সাংবাদিকদের সামনে হাজির হয়ে ইউএনএইচসিআর প্রধান ফিলিপ্পো বলেন, “রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমার সরকার এবং জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) মধ্যে (গত বছরের জুনে) সম্পাদিত চুক্তির অন্যতম মূল বিষয় ছিল, তারা আমাদের শরণার্থীদের ছেড়ে আসা হাজার গ্রাম পর্যবেক্ষণের সুযোগ দেবে। সেই চুক্তির বাস্তবায়ন খুবই ধীর গতিতে এগুচ্ছে।”
তিনি বলেন, “হাজার গ্রামের মধ্যে বড়জোর শ’খানেক গ্রাম আমরা পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছি। এখনো সেখানে রোহিঙ্গাদের ফেরার সুযোগ খুবই সামান্য। তবুও রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে আমাদের কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকবে।”
ফিলিপ্পো জানান, তিনি স্বচক্ষে উত্তর রাখাইনের পরিস্থিতি দেখতে চাইলেও আরাকান আর্মি (এএ) ইস্যুতে তাঁর মিয়ানমার সফরও পিছিয়ে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, রাখাইন নৃগোষ্ঠীর (আরাকানি) বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বিদ্রোহীদের সংগঠন ‘এএ’ গত ৪ জানুয়ারি মিয়ানমারের স্বাধীনতা দিবসে আক্রমণ করে ১৩ জন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে। ওই সময় এই গোষ্ঠীর প্রধান টিওয়ান এমরাট নেয়াং বার্মিজ গণমাধ্যম ইরাবতীকে বলেন, রাখাইনে বেসামরিকদের লক্ষ্য করে চালানো সামরিক আগ্রাসনের জবাব দিতে তাঁরা বিগত কয়েক মাসে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর অন্তত ২৪টি হামলা চালিয়েছেন।
এরই ধারাবাহিকতায় এখনো অস্থির উত্তর রাখাইন।
রোহিঙ্গা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী বাংলাদেশি বিশ্লেষক ড. দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “রাখাইনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সাথে আরাকান আর্মির (এএ) যে সামরিক সংঘাতের কথা বলা হচ্ছে তা সন্দেহজনক।”
“রোহিঙ্গা ইস্যুকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা এবং তাদের ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনাকে আরো অনিশ্চিত করার জন্য সেখানকার তথাকথিত অস্থিরতা ব্যবহার করা হচ্ছে,” যোগ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই অধ্যাপক।
ড. দেলোয়ারের ধারণা, “মিয়ানমার সরকার সম্ভবত আরাকান আর্মিকে ‘ছুতো’ হিসেবে ব্যবহার করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুধু ‘বিলম্বিত’ নয়, অসম্ভব করে তুলতে চাইছে।”
যদিও ফিলিপ্পো জানান, জাতিসংঘের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে মিয়ানমার সরকার সেখানে ৩৫টি ছোট ছোট প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ সরকারের কাছে জাতিসংঘ ‘প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’ বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
‘ভাসানচর’ প্রসঙ্গ
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ফিলিপ্পো গ্রান্ডি বলেন, “রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচরে সুন্দর পরিবেশে আবাসন তৈরি করেছে বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু সেটা যে নিরাপদ তা রোহিঙ্গাদের কোনোভাবেই বিশ্বাস করানো যাচ্ছে না। তাই তারা সেখানে যেতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে।”
“এতে জাতিসংঘ বা সাহায্য সংস্থাগুলোর কোনো হাত নেই। তবে আমরা তাদের জোর করে তাদের ভাসানচরে পাঠানোর বিপক্ষে,” বলেন তিনি।
প্রসঙ্গত, জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলটি বুধবার ঢাকায় পৌঁছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পরের দিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সাথে সৌজন্য সাক্ষাত করে। প্রতিনিধি দলটি বৃহস্পতিবার কক্সবাজার জেলা প্রশাসন এবং ত্রাণ ও রোহিঙ্গা শরণার্থী কমিশনের (আরআরআরসি) সঙ্গেও পৃথক বৈঠক করে।
‘নিরাপত্তার অভাব ও আশাহীনতা’
ফিলিপ্পো গ্রান্ডির অভিমত, মিয়ানমারে ফেরানোর প্রস্তুতি হিসেবে শরণার্থীদের শিক্ষা ও দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ দেওয়া দরকার। যাতে তারা ফিরে গিয়ে কিছু করতে পারে। নয়ত তাদের ভবিষ্যত ভারসাম্যহীন হয়ে যাবে।
সংবাদ সম্মেলনে ওসিএইচএ মহাসচিব মার্ক লোকক বলেন, “এই উদ্বাস্তুদের ভয়াবহতা থেকে রক্ষায় জ্ঞানভিত্তিক দূরদর্শী পদ্ধতির প্রতি মনোযোগী হতে হবে। যাতে তারা সম্মানজনক ভবিষ্যতের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে পারে।”
রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের অধিকাংশেই তরুণ উল্লেখ করে আইওএম মহাসচিব এন্টোনিও ভিটোরিনো বলেন, “মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার পর তারা সফল জীবন গড়ার সুযোগ পাবে, এমন আশ্বাস ও সুযোগ দেওয়া দরকার।”
এর আগে আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে আরকান আর্মির চলমান সংঘাতের কথা উল্লেখ করে বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, “শরণার্থীরা খুব শিগগিরই রাখাইন ফিরে যেতে পারবে এমন সম্ভাবনা নেই।”
‘রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ভালো ভবিষ্যত নির্মাণ’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে নিরাপত্তার অভাব ও আশাহীনতাকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রধান ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করেছে আইসিজি।
শরণার্থী শিবিরগুলোতে জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বাড়ছে বলেও দাবি করেছে তারা।
'জাতিসংঘ দায় এড়াতে পারে না'
এদিকে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে ব্যর্থতার দায় জাতিসংঘ এড়াতে পারবে না বলে জাতিসংঘে জানিয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ বলছে, “রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই সমাধান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ দায় এড়াতে পারে না।”
জাতিসংঘে বাংলাদেশ দূতাবাসের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে শুক্রবার জানানো হয়, স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন সম্প্রতি নিরাপত্তা পরিষদে উচ্চ পর্যায়ের এক উন্মুক্ত আলোচনায় এ কথা বলেছেন।
মাসুদ বলেন, “রোহিঙ্গা সংকটে সৃষ্ট যৌন সহিংসতার মতো অপরাধের দায় নির্ধারণ ও বিচার নিশ্চিত করার মাধ্যমেই কেবল রোহিঙ্গাদেরকে তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনে উৎসাহিত করা যাবে।”