রোহিঙ্গা বহনকারী ট্রলার তীরে ভিড়তে দেবে না বাংলাদেশ
2020.04.27
ঢাকা

মালয়েশিয়ায় আশ্রয় না পেয়ে ফিরে আসা আনুমানিক পাঁচশ রোহিঙ্গা নারী–পুরুষ ও শিশু এখনও গভীর সমুদ্রে ভাসছেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহবান উপেক্ষা করে তাঁদের বহনকারী মাছধরা ট্রলার দুটিকে তীরে ভিড়তে না দেওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছে বাংলাদেশ।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সোমবার বেনারকে বলেন, “এই মহাসাগরের চতুর্দিকে আরো অনেকগুলো রাষ্ট্র আছে। জাতিসংঘের আইন হচ্ছে, এ ধরনের মানবিক দুর্যোগে ভুক্তভোগীদের দেখভাল করার জন্য উপকূলবর্তী দেশগুলোর সমান দায়িত্ব। আমরা ইতিমধ্যে রোহিঙ্গা বোঝাই একটি ট্রলার গ্রহণ করেছি। কিন্তু সবসময় শুধু আমরাই কেন দায়িত্ব নেব?”
“রোহিঙ্গারা আমাদের নয়, মিয়ানমারের নাগরিক। এক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। নতুবা সবাই মিলে এদের দেখভাল করতে হবে। আমরা চাই না কেউ সমুদ্রগর্ভে মারা যাক,” যোগ করেন তিনি।
এর আগে শুক্রবার জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল বাচেলে এবং শনিবার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস এ ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে লেখা এক চিঠিতে মিশেল বাচেলে বলেছেন, কয়েকটি ট্রলারে পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গা নারী-শিশু-পুরুষ এখন সাগরে ভাসছে। বেশ কিছুদিন ধরে সাগরে ভাসা এসব রোহিঙ্গাকে জরুরি ভিত্তিতে খাবার, ওষুধ ও মানবিক সহায়তা দিয়ে আশ্রয় দেওয়া প্রয়োজন।
এর আগে বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর), বুধবার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং আগের সপ্তাহে ফর্টিফাই রাইটস সাগরে ভাসমান রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার আহবান জানায়।
উখিয়া লম্বাশিয়া শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারী রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ রফিক বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ কোনও সময় রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে না দেওয়ার কারণেই মানবিক দেশ হিসেবে পরিচিত। আমরা আশা করি মানব পাচারকারীদের প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়ে সাগরে ভাসমান ওই রোহিঙ্গাদেরও আশ্রয় দেওয়া হবে।”
“এগারো লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে আমরা কি অন্যায় করে ফেলেছি যে দুনিয়ার বাকি রোহিঙ্গাদেরও আশ্রয় দিতে হবে? এটা কি ন্যায়বিচার?” এমন প্রশ্ন তুলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা বা এইচআরডব্লিউর সদর দপ্তর যেসব দেশে আছে তাদের প্রতি অনুরোধ, আপনারা আমাদের দেশ থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যান।”
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “মালয়েশিয়া একটা মুসলিম দেশ, সেখানে লাখ লাখ রোহিঙ্গা নেই। তবুও দেশটি এদের ফেরত পাঠিয়েছে। কারণ তারা সেখানে আশ্রয় পেলে আরো রোহিঙ্গা উৎসাহিত হবে এবং এই পথে মানবপাচার বাড়বে। আমাদের সরকারও নিশ্চয় এই বিষয়টি বিবেচনা করেছে।”
“তবে আমার মনে হয় না ওই মানুষগুলোর ব্যাপারে খুব বেশি মুখ ফিরিয়ে রাখা সম্ভব হবে। কারণ এখানে একটি মানবিক দিক আছে। আমি বিশ্বাস করি সরকার এটাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করতে পারবে না,” যোগ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই অধ্যাপক।
বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের চট্রগ্রাম-পূর্ব জোনের স্টাফ কর্মকর্তা (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (বিএন) এম সাইফুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “আমাদের জলসীমায় এখনও পর্যন্ত রোহিঙ্গা বোঝাই কোনও ট্রলারের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধে তৎপর রয়েছি আমরা।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার উইংয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “ট্রলার দুটি আমাদের নয়, আন্তর্জাতিক জলসীমায় রয়েছে। যে কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেই তাঁদের ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে।”
মালয়েশিয়াতে বাড়ছে রোহিঙ্গা বিরোধী মনোভাব
মিয়ানমারে বাস্তুচ্যূত হয়ে বাংলাদেশের পর রোহিঙ্গাদের দ্বিতীয় প্রধান গন্তব্যস্থল মালয়েশিয়া। শরণার্থী মর্যাদা পাবার সাথে সাথে প্রচুর বিদেশি শ্রমিকের চাহিদা থাকা মালয়েশিয়ায় রোহিঙ্গারা কাজ করারও সুযোগ পান। ফলে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবেরের রোহিঙ্গারাও মুখিয়ে থাকেন যে কোনো উপায়ে মালয়েশিয়া যাবার জন্য।
পাশাপাশি মুসলিম প্রধান মালয়েশিয়ার জনগণও রোহিঙ্গাদের জন্য সহানুভূতিশীল। কিন্তু দেশটিতে হঠাৎ করেই তৈরি হয়েছে রোহিঙ্গা বিরোধী মনোভাব।
সম্প্রতি মালয়েশিয়ার নৌবাহিনী প্রায় ২০০ রোহিঙ্গা শরণার্থী বোঝাই একটি ট্রলারকে তাদের তীরে ভিড়তে দেয়নি। নতুন শরণার্থীদের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে বলে সামান্য কিছু মানবিক সহায়তা দিয়ে নৌকাটিকে নিজেদের জলসীমা থেকে তাড়িয়ে দেয় তারা।
যদিও এর জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের পাশাপাশি দেশটির সরকারের সমালোচনা করেছেন সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান বিরোধীদলীয় নেতা আনোয়ার ইব্রাহিম।
এর মধ্যে গত সপ্তায় মালয়েশিয়ায় বসবাসকারী এক রোহিঙ্গা নেতা দেশটিতে নাগরিকত্ব ও সমান অধিকার দাবি করার অভিযোগে তৈরি হয়েছে ব্যাপক রোহিঙ্গা বিরোধী মনোভাব।
চলমান এই রোহিঙ্গা বিরোধী প্রচারণায় যুক্ত হয়েছেন দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজ্জাকও, যিনি ক্ষমতায় থাকাকালীন রোহিঙ্গাদের অধিকারের পক্ষে অনেক সোচ্চার ছিলেন।
এমন পরিস্থিতিতে দেশের মানুষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির একজন শীর্ষ মন্ত্রী ইসমাইল সাবির ইয়াকুব।
“আমি সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানই, এবং এমন কিছু না করতে অনুরোধ করি যাতে কোনো অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি তৈরি হয়।”
মালয়েশিয়াতে রোহিঙ্গারা দীর্ঘ দিন থেকে বসবাস করছেন এবং তাতে কারো কোনো আপত্তি ছিল না মন্তব্য করে হঠাৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রোহিঙ্গা বিরোধী মনোভাব বেড়ে যাওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেন তিনি।
তবে ওই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মালয়েশিয়ার ‘মিয়ানমার এথনিক হিউম্যান রাইটস অরগানাইজেশন’ এর প্রতিষ্ঠাতা রোহিঙ্গা নেতা জাফর আহমেদ আব্দুল গনি।
“সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেসব বিষয়ের জন্য আমাকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে, আমি কখনো তা বলিনি, দাবি করে এক ইউটিউব বার্তায় তিনি বিষয়টিকে ভুল বোঝাবুঝি বলে উল্লেখ করেন।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর তথ্যমতে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মালয়েশিয়াতে এক লাখ ৮০ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গা রয়েছেন। অন্যদিকে মানবাধিকার সংস্থা ফর্টিফাই রাইটস এর হিসেবে প্রায় সম পরিমাণ অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাও রয়েছেন দেশটিতে।
সরকারি হিসেবে মালয়েশিয়াতে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে মারা গেছেন ৯৯ জন এবং আক্রান্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৮২০ জন।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কুয়ালালামপুর থেকে রে শেরমান ও নিশা ডেভিড।