রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি ‘সভ্যতার কলংক’
2018.05.04

ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা—ওআইসির সহকারি মহাসচিব হাসমি ইউসুফ বলেছেন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি ‘সভ্যতার কলংক’। শুক্রবার দুপুরে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে তিনি এসব কথা বলেন।
ইউসুফ আরও বলেন, “রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার পাশাপাশি জোরালো ভূমিকা রাখবে ওআইসি।”
“ওআইসি কী ভূমিকা নেবে এবং কীভাবে তা পালন করবে—ওই বিষয়ে ওআইসির ৪৫তম পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তাই সম্মেলনে শুরুর আগেই সরেজমিন রোহিঙ্গা পরিস্থিতি ঘুরে দেখেছি আমরা।”
প্রসঙ্গত, ওআইসির দু’দিন ব্যাপী ৪৫তম পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন কাল শনিবার থেকে ঢাকায় শুরু হচ্ছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয় বলে উল্লেখ করে সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সার্বিক সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাস দেন ওআইসির সহকারি মহাসচিব।
শুক্রবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে ঢাকা থেকে বিশেষ বিমানে ওআইসির প্রতিনিধিদল কক্সবাজার বিমানবন্দরে অবতরণ করে।
এরপরই তাঁরা কলাতলীর একটি অভিজাত হোটেলে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা ও শরণার্থী ত্রাণ ও পূনর্বাসন কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেন। বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে প্রতিনিধি দলটি প্রথমে তানজিমারখোলা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যান। সেখান থেকে কুতুপালং ডি-ব্লক পরিদর্শন করেন। ওখানে তাঁরা রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুদের সাথে কথা বলেন।
দুপুর একটার দিকে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করে প্রতিনিধি দল।
ঢাকায় ওআইসি সম্মেলন
রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে ৫৭ মুসলিম প্রধান দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা শনিবার ঢাকায় দুদিনের বৈঠকে বসছেন। এর আগে শুক্রবার তাঁরা কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন।
সম্মেলনে বিশ্বব্যাপী ইসলামোফোবিয়া দূর করার উপায় বের করার পাশাপাশি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সাড়া কীভাবে বাড়ানো যায় সেব্যাপারে ইসলামিক দেশগুলোর মন্ত্রীদের পাশাপাশি কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিসটিয়া ফ্রিল্যান্ড ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর বিশেষ দূত বব রে বক্তব্য রাখবেন। গত বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে এ কথা জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান।
রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে বিশেষ আলোচনা
এ বছরের ইসলামি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকের প্রতিপাদ্য: ‘টেকসই শান্তি, সংহতি ও উন্নয়নের জন্য মূল্যবোধ’।
সম্মেলনে মুসলিম বিশ্বের সংঘাত ও চ্যালেঞ্জ, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি, বিশ্বব্যাপী মুসলমানেরা যে ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি সেগুলোর সমাধানসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হবে।
বিশ্বব্যাপী যে ইসলামোফোবিয়া তৈরি হয়েছে তা দূর করার উপায় তথা সভ্যতা ও সংস্কৃতির আন্তঃসংলাপ, মুসলিম উম্মাহর আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং ওআইসি দেশগুলোর অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়েও আলোচনা হবে।
কানাডার বিশেষ উদ্যোগ
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি ঢাকা সম্মেলনে বিশেষভাবে স্থান পাবে এবং একটি বিশেষ অধিবেশনে তা নিয়ে আলোচনা হবে। তিনি জানান, কানাডার প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত বব রে এবং দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে যোগ দেবেন। কানাডা সরকার রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলাদা বৈঠক আয়োজন করবে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সেদেশের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের উপস্থিতি মিয়ানমারের ওপর বাড়তি আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করবে।
“দেখুন রোহিঙ্গা সংকটে ওআইসি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি, হয়তো পারবেও না। কিন্তু এই সম্মেলনে কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের উপস্থিতি আমাদের জন্য একটি ভালো সুযোগ,” বেনারকে বলেন সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সহসভাপতি হুমায়ুন কবির।
তাঁর মতে, কানাডা রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলাদা অনুষ্ঠান করার কারণ হলো তারা বৈশ্বিক মানবাধিকার সমুন্নত রাখা ও রক্ষার বিষয়টি বিশ্বাস করে।
এদিকে কানাডার প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত বব রে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে জোর প্রচেষ্টা চালানোর জন্য জাতিসংঘের সংস্থাসমূহ এবং অন্যান্য বৈশ্বিক ফোরামগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার নগরীর ব্র্যাক সেন্টার অডিটোরিয়ামে এক উন্মুক্ত আলোচনায় বব রে বলেন, “নীরব থাকলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে। এ জন্য জাতিসংঘের সংস্থাসমূহ এবং অন্যান্য ফোরামকে আরো কথা বলতে হবে।” ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস (সিপিজে) এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে
চাপ অব্যহত রাখবে যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিরাপদে ও স্বেচ্ছায় তাঁদের নিজ দেশে পাঠাতে তাঁর দেশের চাপ অব্যাহত রাখার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছেন। এ বিষয় প্রধানমন্ত্রীকে পাঠানো এক চিঠিতে ট্রাম্প এ আশ্বাস দেন। সরকারি বার্তা সংস্থা বাসস গত বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকায় এই তথ্য প্রকাশ করে।
বাসস জানায়, ট্রাম্প চিঠিতে শেখ হাসিনাকে বলেন, “রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিরাপদে ও স্বেচ্ছায় তাঁদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি তৈরির জন্য যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের প্রতি চাপ অব্যাহত রাখবে।”
এর আগে বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া ব্লুম বার্নিকাট প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে এই চিঠি তাঁর কাছে হস্তান্তর করেন।
বৈঠকের পরে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিমের বরাত দিয়ে বাসস জানায়, চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বলেন, এ ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন নেই যে এই সংকট সৃষ্টির জন্য দায়ী মিয়ানমারকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের বাংলাদেশ সফরের পর ওআইসি প্রতিনিধিদলের এই সফর বিরাট ঘটনা। এসব সফর মিয়ানমারকে চাপে ফেলবে সন্দেহ নেই। এসবের পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া ট্রাম্পের চিঠিও বশে গুরুত্বপূর্ণ।