বিশ্লেষকদের অভিমত, রোহিঙ্গা সংকটের মানবিক দিক এড়িয়ে যাচ্ছে চীন
2019.05.10
ঢাকা
রাখাইন রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যেই রোহিঙ্গা সমস্যার ‘আসল’ সমাধান রয়েছে বলে চীনা রাষ্ট্রদূতের মন্তব্যের সাথে দ্বিমত করেছেন বিশ্লেষক ও বাংলাদেশি কর্মকর্তারা।
তাঁরা বলছেন, নিজেদের স্বার্থের কারণে চীন শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলে রোহিঙ্গা সংকটের মানবিক দিকটা এড়িয়ে যাচ্ছে।
গত ৮ মে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে চীনের রাষ্ট্রদূত জিয়াং জু বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুটি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে চীন। রাখাইন রাজ্যে দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে এই সংকট মোকাবেলা করতে চায় তাঁর দেশ।
আর এ জন্য পিছিয়ে পড়া রাখাইনের উন্নয়ন প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে রাষ্ট্রদূত বলেন, “বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার (বিসিআইএম) অর্থনৈতিক করিডোরের মাধ্যমে রাখাইন রাজ্যকে উন্নয়নের আওতায় আনা সম্ভব।”
রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে চীন গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে চায়- একথা উল্লেখ করে জিয়াং জু বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি এই সমস্যার আসল সমাধান নিহিত রাখাইন রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন মনে করেন “চীন অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলে রোহিঙ্গাদের মানবিক দিকটি উপেক্ষা করছে।”
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বেনারকে বলেন, রোহিঙ্গারা কীভাবে ফেরত যাবে সে বিষয়টি নিয়ে চীন কথা বলছে না।
“রাখাইনে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেই যে রোহিঙ্গারা ফিরে যাবে বিষয়টি এমন নয়। সেখানে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে,” বলেন ফাহমিদা।
তাঁর মতে, “রোহিঙ্গাদের মৌলিক চাহিদা, স্বাধীনভাবে চলফেরার অধিকার, শিক্ষা, চাকরির সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। আর এ জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি মিয়ানমারের সরকারের অঙ্গীকার প্রয়োজন।”
ওই সংবাদ সম্মেলনে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মনিরুজ্জামান।
শুক্রবার তিনি বেনারকে বলেন, “চীনের রাষ্ট্রদূত পরোক্ষভাবে বলার চেষ্টা করেছেন, বিসিআইএম করিডোর বাস্তবায়ন করতে গেলে রাখাইনের ভেতর দিয়ে আসতে হবে। কাজেই রাখাইনে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হওয়াটা পূর্বশর্ত।”
তিনি বলেন, “চীন জাতীয় স্বার্থকে অত্যন্ত সংকীর্ণভাবে দেখছে। কারণ রাখাইনের উন্নয়ন রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র সমাধান নয়।”
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ আবুল কালাম বেনারকে বলেন, “শুধুমাত্র উন্নয়ন দিয়ে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হবে না।”
তাঁর মতে, “এখানে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ব্যাপার আছে। রোহিঙ্গারা কীভাবে সেখানে থাকবে, কী অধিকার নিয়ে থাকবে এই বিষয়গুলোর ফয়সালা না হলে আসলেই কোনো সমাধান আসবে না।”
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে সাড়ে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এর আগে থেকে আরও চার লাখ রোহিঙ্গা এদেশে বসবাস করত।
আগের অবস্থানেই চীন
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য নানামুখী তৎপরতার মধ্যে বারবারই মিয়ানমারকে সমর্থন দিয়েছে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত ভারত, রাশিয়া এবং চীন। এমনকি রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যে পদক্ষেপই নেওয়ার চেষ্টা করেছে তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সংস্থাটির স্থায়ী সদস্য চীন এবং রাশিয়া।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মুনিরুজ্জামান বলেন, “রাখাইনে ভারত একটি বড় বন্দর তৈরি করছে। তাদের নর্থ ইস্টকে যুক্ত করতে মাল্টি মোডাল হাইওয়ে করছে। চীন সেখানে গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপন করছে। তাদের এনার্জি টার্মিনালের কাজ চলছে। আর এ সবই হচ্ছে মিয়ানমারের সাথে পৃথক দ্বিপাক্ষিক চুক্তির আওতায়।”
তাঁর মতে রাখাইনে ভারত ও চীনের এইসব স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ের কারণেই রোহিঙ্গা সংকটের শুরুতে চীন এবং ভারত যেভাবে মিয়ানমারকে সমর্থন দিয়ে আসছিল তাদের সে মনোভাবে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
“ফলে এ সংকট নিরসনে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বহুমাত্রিক যে কূটনৈতিক তৎপরতা ছিল সেটা চালিয়ে যাওয়া দরকার। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে,” বলেন তিনি।
তিনি মনে করেন, “এ সমস্যা দীর্ঘমেয়াদী পর্যায়ে পড়ে গেলে সমাধান কঠিন হবে। তাই বন্ধু দেশগুলোর সাথে কূটনৈতিক তৎপরতা আরো বাড়াতে হবে।”
তবে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা মনে করেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে চীন এবং ভারতের মতো প্রভাবশালী দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের ফলপ্রসু ডায়ালগ হচ্ছে না।
তিনি বলেন, “আমরা মিয়ানমারের উপর কোনো চাপ দিতে পারছি না। আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক প্লাটফর্মগুলো ব্যবহার করে দেশটির উপর চাপ সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে।”
“বিমসটেক, বিসিআইএম-এর মতো আঞ্চলিক প্ল্যাটফর্মে বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু মিয়ানমারের উপর চাপ দিতে আমরা এসব প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করতে পারছি না। আন্তর্জাতিকভাবেও পারছি না,” মনে করেন ড. ফাহমিদা খাতুন।
অর্থনীতিকে পৃথক রাখছে বাংলাদেশ
রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনকে পাশে না পেয়েও দেশটির সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা বলছেন, কৌশলগত কারণেই বাংলাদেশ দুটো বিষয়কে আলাদাভাবে পরিচালনা করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, “চীন বরাবরই রোহিঙ্গা ইস্যুকে অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে। তবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন আর রোহিঙ্গা ইস্যু দুটিকে আলাদাভাবে পরিচালনা করছে বাংলাদেশ।”
“রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন, রাশিয়া এমনকি ভারতও সহায়তা করছে না। একদিকে তারাও রোহিঙ্গাদের সহায়তা পাঠাচ্ছে আবার আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারের পাশে দাঁড়াচ্ছে,” বলেন তিনি।
ড. দেলোয়ার বলেন, “ভূ-রাজনৈতিক কারণে এসব দেশ বাংলাদেশের অনুরোধকে আমলে নিচ্ছে না। অন্যদিকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আবার রোহিঙ্গা ইস্যুর চেয়ে গুরুত্বপুর্ণ। চীন বা ভারতের বিনিয়োগ বাংলাদেশের প্রয়োজন। চীন আমাদের প্রধান বাণিজ্যিক অংশিদার আর ভারত দ্বিতীয়।”
তিনি মনে করেন, “রোহিঙ্গা ইস্যুটা একটা দীর্ঘমেয়াদী চ্যালেঞ্জ হিসেবে চলে যাচ্ছে। তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাবাসন যেটা আমরা আশা করেছিলাম সেটা হয়নি। সে বিষয়ে চীনের সমর্থনের জন্য বাংলাদেশ চেষ্টা করছে। এই কূটনৈতিক তৎপরতা আরো বাড়াতে হবে।”