ফের কক্সবাজার থেকে সমুদ্রপথে মানবপাচার চেষ্টা, গ্রেপ্তার ১৯

জেসমিন পাপড়ি ও আবদুর রহমান
2017.05.11
ঢাকা ও টেকনাফ
সাগর পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টার সময় কক্সবাজারে আটক রোহিঙ্গা সদস্যরা। সাগর পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টার সময় কক্সবাজারে আটক রোহিঙ্গা সদস্যরা। মে ০৯, ২০১৭।
আবদুর রহমান/বেনারনিউজ

কক্সবাজার থেকে ফের সাগর পথে মালয়েশিয়ায় মানব পাচারের চেষ্টা শুরু হয়েছে। গত মঙ্গলবার কক্সবাজারের টেকনাফে দুই দালালসহ ১৯ মালয়েশিয়াগামীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাইন উদ্দিন খান বেনারকে জানান, “ওইদিন ভোর সাড়ে চারটার দিকে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের হাতিয়ারগুনা এলাকার একটি ঘর থেকে তাদের আটক করা হয়।”

পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তার হওয়া দুই দালাল বাংলাদেশি। বাকি ১৭ জনই মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা। এদের বয়স ১৯ থেকে ৪০ বছর। এ ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে।

এর আগে ২০১৫ সালের মে মাসে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার উপকূলে অসংখ্য গণকবর আবিষ্কৃত হয়। মিয়ানমার, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে সমুদ্র পথে পাচারের শিকার হয়ে বন্দি শিবিরে কিংবা যাত্রাপথে প্রাণ হারানো মানুষদের এসব কবর সেসময়ে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে।

সেই সময় অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, বাংলাদেশের কক্সবাজার সীমান্ত মানব পাচারের অন্যতম রুট। তখন নড়েচড়ে বসে দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। মানব পাচারকারীদের গ্রেপ্তার ও তাদের কয়েকজন কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়ার পর গত দুই বছর এই রুটে মানব পাচার প্রায় বন্ধ রয়েছে।

এরই মধ্যে বঙ্গোপসাগর দিয়ে মানব পাচার শুরুর প্রচেষ্টাকে অশনি সংকেত বলে মনে করছে বিশ্লেষকেরা।

এ প্রসঙ্গে অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন ওয়ারবি ফাউন্ডেশনের প্রধান সৈয়দ সাইফুল হক বেনারকে বলেন, “হঠাৎ করেই টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে মানব পাচারের চেষ্টার খবর দেশের জন্য অশনি সংকেত। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী একটু গাফিলতি দেখালেই তারা সক্রিয় হয়ে উঠবে।”

দালালেরা রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি বাংলাদেশিদেরও টার্গেট করতে পারে মর্মে আশঙ্কা করে সাইফুল বলেন, “মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য ১৪ লাখ বাংলাদেশি নিবন্ধন করেছিলেন। সেখান থেকে মাত্র কয়েক হাজার দেশটিতে যেতে পেরেছেন। বাকিরা সুযোগ পেলে অবৈধ পথেও মালয়েশিয়া যেতে রাজি হবেন। দালালরা সেই সুযোগ নিতে চায়।”

তাঁর মতে, সরকারের উচিত মানুষকে সচেতন করা ও বৈধ পথে অধিক হারে কর্মী পাঠানোর ব্যবস্থা করা।”

তবে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক আলী হোসেন বেনারকে বলেন, “কক্সবাজার থেকে মানব পাচার শূন্যের কোঠায় রয়েছে। মানব পাচারকারীদের ধরতে ও মানব পাচার ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সবসময় তৎপর রয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় টেকনাফের ঘটনাও প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছে।”

“দুই বছর ধরে টেকনাফ থেকে মানব পাচার শুন্যের কোঠায় রয়েছে। যেকোনো মূল্যে এ অবস্থান ধরে রাখা হবে,” বলেন জেলা প্রশাসক।

দুটি মামলা

আটক ১৭ জন মিয়ানমারের নাগরিক ও দুই বাংলাদেশি দালালের বিরুদ্ধে মানব পাচার ও বৈদেশিক আইনে পৃথক দুটি মামলা করার কথা জানিয়েছেন টেকনাফ মডেল থানার ওসি মাঈন উদ্দিন খান।

আটককৃতরা হলেন; টেকনাফ সদর ইউনিয়নের হাতিয়ারগুনার দালাল খলিল ওরফে ইসমাল (৩৬) ও বুলবুলি (৩৫)।

মিয়ানমারের নাগরিকেরা হলেন; মো. জামাল (২২), জুবাইর (১৯), মো: ইলিয়াছ (১৯), মো. রফিক (১৯), মো: ইদ্রিস (১৯), নুরুল ইসলাম (১৯), মো. সেলিম (১৯), মো: আয়ুব (২০), ইউনুস (৪০), মো. জুবাইর (১৯), জাহেদ হোসেন (১৯), আবদুল হক (৪০), আছিয়া বেগম (১৯), ছমিরা বেগম (১৯), রফিকা বেগম (২৫), আজিদা বেগম (১৯) ও বলিবাজারের বাসিন্দা মো: রফিক (২০)।

ওসি মাঈন উদ্দিন জানান, সাগর পথে মালয়েশিয়া পাড়ি দিতে টেকনাফ হাতিয়াগুনার একটি ঘরে লোকজন জড়ো করা হচ্ছে এমন গোপন সংবাদ পেয়ে পুলিশের একটি টিম ওই এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে। এসময় তাদের আটক করা হয়। তাদের সঙ্গে দুই জন শিশুও ছিল।

তিনি জানান, আটক যাত্রীরা ওই এলাকার দালাল ফাতেমা বেগম নামে এক নারীকে সাগর পথে মালয়েশিয়া যাবার জন্য প্রতিজন ১০ হাজার টাকা করে দিয়েছে বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে।

“যাত্রীদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী হাতিয়ারগুনার আবুল হোসেন ও ফাতেমা বেগমকে পলাতক আসামি করে একটি মানব পাচার ও বৈদেশিক আইনে মামলা রুজু করা হয়েছে,” বলেন মাঈন উদ্দিন।

তিনি বলেন, “টেকনাফের যেকোনো এলাকার ঘরে অথবা বাইরে লোকজন জড়ো হতে দেখলে তাৎক্ষণিকভাবে ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যানদের পুলিশকে খবর দিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি পলাতক মানব পাচারকারীদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।”

এদিকে পুলিশের হাতে আটক মো. ইলিয়াছ বেনারকে বলেন, “মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসি। টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা বস্তিতে মো. রশিদের বাড়িতে আশ্রয় নিলেও কাজ পাইনি। তাই সাগর পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম।”

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত বছরে টেকনাফে ২৬ জন দালালকে আসামি করে মানব পাচারের পাঁচটি মামলা হয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকজন গ্রেপ্তার হলেও বেশিরভাগ পাচারকারীই পলাতক রয়েছে।

চলতি বছরের গত ৪ মাসে ১৩ জন মানব পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানান ওসি মাঈন উদ্দিন। বাকি শীর্ষ পাচারকারীদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।

টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এসএম আরিফুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “টেকনাফ থেকে সাগর পথে মানব পাচার বন্ধ রয়েছে এবং বন্ধ থাকবে। কোনোভাবে সাগর পথে মানব পাচার হতে দেওয়া হবে না।”

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সীমান্তের তিনটি চেকপোস্টে অস্ত্রধারীদের হামলায় দেশটির নয়জন সীমান্তরক্ষী নিহত হওয়ার পর রোহিঙ্গাদের দমনে সেনাবাহিনীর অভিযান শুরু হয়। ওই ঘটনার পর প্রায় ৭০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেন। এর আগে থেকে আরো সাড়ে তিন লাখের মতো রোহিঙ্গা গত কয়েক দশকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে বসবাস করছেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।