দুই দিনে মালয়েশিয়াগামী ৮০ রোহিঙ্গা আটক
2019.05.14
ঢাকা ও কক্সবাজার

দুই দিনে সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়াগামী ৮০ জন রোহিঙ্গাকে আটকে দিয়েছে পুলিশ, যাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। এদের কেউ চাকরি আবার কেউ কেউ বিয়ের প্রলোভনে পড়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
এদিকে সোমবার দিবাগত রাতে পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন দুজন রোহিঙ্গা, তাঁরা মানবপাচারকারী ছিলেন বলে পুলিশের দাবি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো বলছে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে মানব পাচারকারী চক্র ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বেনারকে বলেন, “মানব পাচারের জন্য কক্সবাজার একটা হাব, যেখান থেকে প্রলোভন দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাওয়া সহজ। ফলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পাচারকারী ও দালালেরা এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে।”
“শিবিরগুলোতে অন্যান্য বিষয়ে নজর দেওয়া হলেও তারা যে পাচারের শিকার হতে পারে সে বিষয়ে কোনো সচেতনতামূলক কর্মসূচি নেই। অল্পবয়সী রোহিঙ্গা নারীদের বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে যৌনকর্মী হিসেবে বিক্রি করা হয়। এ বিষয়ে তাদের সচেতন করতে উদ্যোগ নিতে হবে,” যোগ করেন তিনি।
গত রবি ও সোমবারের মধ্যে কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া ও মহেশখালী উপকূলীয় এলাকায় অভিযান চালিয়ে অন্তত ৮০ জন রোহিঙ্গাকে আটক হয় বলে বেনারকে জানান কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন।
তিনি বলেন, “হঠাৎ করে রোহিঙ্গা পাচার বেড়ে যাওয়ায় আমরাও চিন্তিত। উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গারা মানবপাচার চক্রের প্রলোভনের শিকার হয়ে অবৈধভাবে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেছিল।”
“তবে পুলিশ মানব পাচারকারীদের ধরতে মাঠে নেমেছে। সমুদ্রপথে মানব পাচার রোধে পুলিশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে,” বলেন ইকবাল হোসেন।
আটক রোহিঙ্গাদের স্ব স্ব রোহিঙ্গা শিবিরে পাঠানো হয়েছে বলেও জানান কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার।
চার মাসে সাড়ে ৪শ রোহিঙ্গা আটক
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানায়, গত চার মাসে সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাত্রাকালে প্রায় সাড়ে চার শ রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে, যাদের বেশি ভাগই নারী ও শিশু।
এর মধ্যে পুলিশ প্রায় চারশ’, র্যাব নয়জন এবং বিজিবি ৪২ জনকে আটক করে। তারা সবাই উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা।
স্থানীয় পুলিশের দেওয়া তথ্য মতে, ১৩ মে কক্সবাজারের টেকনাফের বাহারছড়া থেকে ১৯ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ, যার মধ্যে ৫ জন শিশু, ১২ জন নারী ও ২ জন পুরুষ। এরা সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য উপকূলের বাহারছড়ায় অবস্থান করছিল। একই দিন জেলার মহেশখালীর পাহাড়ি এলাকা থেকে মালয়েশিয়াগামী আরও ২৮ রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়।
আগের দিন একই এলাকা থেকে আরও ১২ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ। যার মধ্যে ৮ জন শিশু ও ২০ জন নারী রয়েছে।
এ ছাড়া ১৩ মে উখিয়ায় ইনানী উপকূল দিয়ে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রস্তুতিকালে ২৩ রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ। এর মধ্যে ১৭ জন নারী, ৪ জন শিশু ও ২ জন পুরুষ। যারা কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে পালাচ্ছিলেন।
এর আগে ২০১৫ সালের মে মাসে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার উপকূলে অসংখ্য গণকবর আবিষ্কৃত হয়। মিয়ানমার, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে সমুদ্রপথে পাচারের শিকার হয়ে বন্দী শিবিরে কিংবা যাত্রাপথে প্রাণ হারানো মানুষদের এসব কবর সে সময়ে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
ওই বছর সালে প্রায় ২৫ হাজার রোহিঙ্গা সমুদ্রপথে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া যাবার চেষ্টা করছিলেন বলে এক প্রতিবেদনে জানায় বার্তাসংস্থা রয়টার্স।
উন্নত জীবনের আশা
রোহিঙ্গা নেতাদের ভাষ্যমতে, মালয়েশিয়ায় আত্মীয়-স্বজন রয়েছে এমন রোহিঙ্গারা উন্নত জীবনের আশায় শিবির থেকে বের হয়ে সমুদ্রপথে দেশটিতে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করছে। এই প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গা দালালের পাশাপাশি স্থানীয় কিছু দালালও টাকার বিনিময়ে যুক্ত হচ্ছে।
উখিয়া রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা মোহাম্মদ আইয়ুব বেনারকে বলেন, “শিবিরে আশ্রয় নেওয়া কর্মহীন রোহিঙ্গাদের বেশি আয়ের লোভ দেখিয়ে মানব পাচারকারীরা সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যেতে উৎসাহিত করছে। এ ছাড়া তাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন ও ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হবে এমন ভয়ও দেখানো হয়।”
উদ্ধার হওয়া মালয়েশিয়াগামীদের বরাত দিয়ে টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন জানান, রোহিঙ্গা নারীদের বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে মালয়েশিয়া পাচার করা হচ্ছিল।
তিনি বেনারকে বলেন, “পাঁচ হাজার টাকা করে নিয়ে একদিন আগে তাদের একত্রিত করে দালালরা। সোমবার রাতে সমুদ্রে একটি ট্রলারে এসব রোহিঙ্গাদের তুলে দেওয়ার কথা ছিল। মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পর মাথাপিছু দেড় লাখ দুই লাখ টাকা করে দেওয়ার চুক্তি ছিল।”
দুই ‘মানবপাচারকারী’ নিহত
গত সোমবার রাতে পুলিশের সঙ্গে মানব পাচারকারীদের গোলাগুলির ঘটনায় দুই রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছেন টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ।
তিনি বলেন, “টেকনাফের শাপলাপুর উপকূল দিয়ে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়াগামী রোহিঙ্গাদের জড়ো করে ট্রলারে উঠিয়ে দেওয়ার খবরে পুলিশ সেখানে অভিযান চালায়। এ সময় পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় পাচারকারীরা। আত্মরক্ষার্থে পুলিশও পাল্টা গুলি করে। এ ঘটনায় দুই রোহিঙ্গার মৃত্যু হয় এবং চার পুলিশ সদস্য আহত হয়।”
নিহত রোহিঙ্গারা হলেন; টেকনাফের বাহারছড়া শামলাপুর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আব্দুর রহিমের ছেলে আজিম উল্লাহ (২৫) ও জামতলী ক্যাম্পের মৃত রহিম আলীর ছেলে আব্দুস সালাম (৫২)। আহত পুলিশ সদস্যরা হলেন; এএসআই জহিরুল, কনেস্টবল মানিক মিয়া, মোবারক হোসেন ও খায়রুল।
ওসি বলেন, “যেসব মানবপাচারকারী সক্রিয় হয়ে উঠছে তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। যে-কোনই মূল্যে সমুদ্রপথে মানব পাচার বন্ধ করা হবে। ”
এ প্রসঙ্গে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রবিউল হাসান বেনারকে বলেন, ‘হঠাৎ করে মালয়েশিয়াগামী আটকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে, একটি দালাল চক্র রোহিঙ্গা শিবিরে সক্রিয় হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারীদের প্রলোভন দেখিয়ে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পাচারের চেষ্টা চলছে।”
“তবে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা ওই চক্রকে গ্রেপ্তার ও প্রতিহত করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে,” জানান নির্বাহী কর্মকর্তা।