রোহিঙ্গা শিবিরে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত
2020.05.14
কক্সবাজার ও ঢাকা

প্রথমবারের মতো কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে একজন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন।
আক্রান্ত রোহিঙ্গা উখিয়ার কুতুপালং শিবিরের বাসিন্দা বলে বেনারকে জানান শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মো. মাহবুব আলম তালুকদার।
রোহিঙ্গা শিবির থেকে সংগ্রহ করা নমুনার মধ্যে বৃহস্পতিবার দুজনকে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত করা হয় বলে বেনারকে জানান কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মো. মাহবুবুর রহমান। এদের মধ্যে একজন রোহিঙ্গা পুরুষ।
“রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে সংগ্রহ করা নমুনা মেডিকেল কলেজ ল্যাবে পরীক্ষা করে দুইজনের করোনা পজেটিভ পাওয়া গেছে,” মন্তব্য করে ডা. মাহবুবুর রহমান বলেন, “তাঁদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হবে।”
“আক্রান্তদের মধ্যে রোহিঙ্গা একজন। অন্যজন ভালো চিকিৎসা সেবা পাওয়ার জন্য রোহিঙ্গা পরিচয়ে কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালে যান। সেখানে তাঁর নমুনা সংগ্রহ করা হয় এবং রিপোর্ট পজেটিভ আসে,” বেনারকে জানান শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের স্বাস্থ্য সমন্বয়কারী ডা. আবু মোহাম্মদ তোহা।
তিনি বলেন, “প্রাথমিকভাবে তাঁকে রোহিঙ্গা ভাবলেও পরে আমরা খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারি তিনি রোহিঙ্গা নন।”
আক্রান্ত ওই ব্যক্তি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম কচুবনিয়ার স্থানীয় বাসিন্দা এবং বর্তমানে তিনি নিজ বাড়িতেই আছেন বলে জানান ডা. তোহা।
বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মোট ২৫০ জন রোহিঙ্গার নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে বলে জানান শরণার্থী কমিশনার।
আক্রান্ত রোহিঙ্গাকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বিধি মেনে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে বলে বেনারকে জানান জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) ঢাকা অফিসের মুখপাত্র মোস্তফা মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন।
এছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবারকেও কোয়ারেন্টিনে রাখা হবে বলে জানিয়েছেন শরণার্থী কমিশনার মাহবুব আলম তালুকদার।
মিয়ানমারের সেনাদের অভিযান থেকে প্রাণে বাঁচতে দেশটির রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় শরণার্থীশিবিরে বসবাস করছেন। অত্যন্ত ঘণবসতিপূর্ণ এসব শিবিরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সম্ভাব্য পরিণিতি সম্পর্কে বিভিন্ন সময় আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন।
রোহিঙ্গা শিবিরের সার্বিক পরিস্থিতির দ্রুত উন্নয়নের জন্য বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ফিজিশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস (পিএইচআর)।
“ঘনবসতিপূর্ণ ও ঘিঞ্জি আবাসস্থল, স্বাস্থ্যসেবার নাজুকতা, পরিচ্ছন্নতা ও তথ্যপ্রাপ্তির অভাব শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য ও মানবাধিকারকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে,” বিবৃতিতে বলেন পিএইচআর-এর সিনিয়র মেডিক্যাল উপদেষ্টা ও জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেমিলি মেডিসিনের অধ্যাপক রেইনট মিশরি।
কক্সবাজার স্বাস্থ্য বিভাগ জানায়, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জেলায় একজন রোহিঙ্গাসহ মোট ১৩১ জন করোনাভাইরাস আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন। করোনাভাইরাসে এখন পর্যন্ত কক্সবাজারে মারা গেছেন একজন।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম রোগী শনাক্ত হন ৮ মার্চ, এ রোগে প্রথম ব্যক্তির মৃত্যু হয় ১৮ মার্চ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনাভাইরাসে মারা গেছেন ১৪ জন, আক্রান্ত নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন এক হাজার ৪১ জন।
বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৮৬৩ ও মৃত ২৮৩ জনে।
যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৪৪ লাখ ২০ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন তিন লাখ এক হাজারের বেশি।
শরণার্থী শিবিরে উদ্বেগ
প্রথম কোনো রোহিঙ্গা করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় শরণাথী শিবিরগুলোতে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। তবে ক্যাম্পে সামাজিক দূরত্ব মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের নেতা সৈয়দ উল্লাহ বেনারকে বলেন, “ক্যাম্পে করোনা আক্রান্ত রোগী চিহ্নিত হওয়ার খবরে লোকজন ভয়ে আছে। ক্যাম্পে ঘিঞ্জি বসতি হওয়ায় ঝুঁকিটাও বেশি।”
তাঁর মতে, এখন পর্যন্ত করোনা সংক্রমণ রোধে চোখে পড়ার মতো কার্যক্রম নেওয়া হয়নি। কীভাবে এই ভাইরাস থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়, সেটি অনেকেই এখন পর্যন্ত জানে না।
উখিয়া কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ রফিক বেনারকে বলেন, “শিবিরের লোকজন কোনো ধরনের নিয়নকানুন মানছে না। যে, যার মতো চলাফেরা করছে।”
“ঘনবসতি এলাকা হওয়ায় সেখানে করোনা ঝুকিঁ বেশি থাকলেও একদিকে সচেতনতা কম, অন্যদিকে প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম নেই,” বলেন তিনি।
কক্সবাজার জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন বলেন, “করোনা প্রতিরোধে ক্যাম্পে সামাজিক দূরত্ব, লকডাউন নিশ্চিতে পুলিশ আরও কঠোর হচ্ছে।”
পঞ্চাশ লাখ পরিবারকে সহায়তা
মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ৫০ লাখ পরিবারের প্রত্যেককে আড়াই হাজার টাকা করে নগদ অর্থ প্রদান করবে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে এই কর্মসূচি উদ্বোধন করেন।
এ সময় “প্রতিটা জায়গায় মানুষের কষ্টটা দূর করাটাই লক্ষ্য” মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “কিঞ্চিৎ পরিমাণ দিলেও যেন দিতে পারি, কেউ যেন বঞ্চিত না হয়।”
ঈদের আগে সকল মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন এবং সাত হাজার কওমি মাদ্রাসাকে আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
করোনাভাইরাসের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষ ও দেশে ফেরা প্রবাসীরা যাতে স্বল্প সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারেন, সে জন্য, কর্মসংস্থান ব্যাংকে ২ হাজার কোটি এবং প্রবাসী কল্যাণ নামে একটি বিশেষায়িত ব্যাংকে ৫০০ কোটি টাকা আমানত দেয়া হবে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
এদিকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) জানায় করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবেলায় চিকিৎসা সেবা খাতের সক্ষমতা বাড়াতে বাংলাদেশকে ১০ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ৮৫০ কোটি টাকা।
বুধবার ইআরডি ও এডিবির মধ্যে এই ঋণ চুক্তি হয় বলে জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে।