আরসার হামলার আশঙ্কায় বাংলাদেশের সহায়তা চাইল মিয়ানমার
2018.05.17
ঢাকা

জঙ্গি সংগঠন আরসার সদস্যরা বাংলাদেশে একত্রিত হয়ে মিয়ানমারের ওপর হামলা চালাতে পারে বলে আশঙ্কা করে এ ব্যাপারে বাংলাদেশের কাছে সহযোগিতা কামনা করেছেন সফররত মিয়ানমার পররাষ্ট্রসচিব উ মিন্ট থু।
বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন তদারকির জন্য গঠিত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের দ্বিতীয় সভায় এই সহযোগিতা কামনা করা হয়। জবাবে বাংলাদেশ বলেছে, সরকার কোনোভাবেই কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনকে বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে অন্য রাষ্ট্রের ক্ষতি করতে দেবে না।
বৈঠকে বাংলাদেশ রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের ওপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন মেঘনায় অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের দেওয়া প্রস্তাবগুলো যে গুরুত্বপূর্ণ, তা স্বীকার করেছে মিয়ানমার। তবে বাংলাদেশের প্রস্তাব আর অনুরোধ অনুযায়ী তারা কী কী পদক্ষেপ নেবে তা স্পষ্ট করা হয়নি দেশটির পক্ষ থেকে।
বৈঠকে পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক বাংলাদেশের এবং মিয়ানমারের পররাষ্ট্রসচিব মিন্ট থোয়ে তাঁর দেশের নেতৃত্ব দেন।
সভা শেষে পররাষ্ট্রসচিব শহিদুল হক তাঁর মিয়ানমার প্রতিপক্ষকে সাথে নিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, দুই দেশই দ্রুত প্রত্যাবাসন শুরু করতে একমত হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন মেঘনায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে পররাষ্ট্রসচিবের নেতৃত্বে দুই দেশের ১৫ জন করে সদস্য যোগদান করেন।
শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বেনারকে বলেন, “মিয়ানমার প্রতিনিধি দল জঙ্গি সংগঠন আরসার বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। তারা বলেছে, তাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য আছে যে আরসার সদস্যরা জড়ো হয়ে মিয়ানমারে আক্রমণ চালাতে পারে। আর আমরা বলেছি, বাংলাদেশে আরসার কোনো উপস্থিতি নেই। আমরা কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনকে নীতিগতভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিই না। সুতরাং, এব্যাপারে ভয়ের কিছু নেই।”
তিনি বলেন, উদাহরণ হিসেবে, মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়, আরসার সদস্যরা বাংলাদেশে ক্যাম্পে তাদের বিরোধী লোকদের হত্যা করছে।
পুনর্বাসন কমিশনার কালাম বলেন, আমরা বলেছি আসলে ক্যাম্পে সংগঠিত হানাহানিগুলো হলো ব্যবসা ও অন্যান্য ছোট অপরাধমূলক বিষয়। এগুলোর কোনটিই সন্ত্রাসের বিষয় নয়।
আবুল কালাম বলেন, বৃহস্পতিবারের সভায় বাংলাদেশের পক্ষে মিয়ানমারের কাছ থেকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। মিয়ানমার প্রতিনিধিদল বলেন, প্রত্যাবাসন ফরমগুলো সঠিকভাবে পূরণ করা হয়নি।
মিয়ানমার পররাষ্ট্রসচিব থু বলেন, যেসব মানুষদের ব্যাপারে মিয়ানমার যাচাই বাছাই শেষ করেছে তাদের দিয়েই প্রত্যাবাসন শুরু করা যেতে পারে।
জবাবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে রাখাইনে প্রত্যাবাসনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি না করতে পারলে রোহিঙ্গারা যাবে না। বাংলাদেশ কাউকে জোর করে ফেরত পাঠাবে না।
“তাই, আমাদের পক্ষ থেকে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে,” বলেন শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার কালাম।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে রাখাইনে মুসলিম বিরোধী প্রচারণা চলছে। দ্বিতীয়ত, রাখাইনের রাজনীতিকেরা রোহিঙ্গা ও প্রত্যাবাসন বিরোধী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।
এই বিষয়গুলো সম্পর্কে রোহিঙ্গাদের ভয় রয়েছে। এগুলো বন্ধ না করলে রোহিঙ্গারা সেখানে ফিরে যেতে চাইবে না।
“জবাবে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা এগুলো বন্ধ করার চেষ্টা করছে,” বলেন আবুল কালাম।
তিনি বলেন, মিয়ানমার প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে রোহিঙ্গাদের গ্রামের নামের সঠিক বানান বাংলাদেশকে সরবরাহ করবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, রাখাইনে বর্তমানে ‘এথনিক ভিলেজ’ তৈরি করা হচ্ছে। সেখানে ম্রো, রাখাইন ও অন্যান্য অমুসলিম সম্প্রদায়গুলোকে বসানো হচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার অনাগ্রহের ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা ফিরে গিয়ে মুক্তভাবে চলাচল করতে পারবে না বলে রোহিঙ্গারা মনে করে। তাই তাদের চলাচলের স্বাধীনতা বাড়ানো দরকার।
জবাবে মিয়ানমার পররাষ্ট্রসচিব সভায় বলেন, তারা জাতীয় যাচাই কার্ড (এনভিসি) নিলেই তাদের চলাচলের স্বাধীনতা বাড়বে।
জবাবে বাংলাদেশ প্রতিনিধি বলেন, রোহিঙ্গারা জাতীয় যাচাই কার্ড (এনভিসি) নিতে চায় না।
এরপর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের মধ্যে এনভিসি সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে বাংলাদেশকে তারা সঠিক তথ্য সরবরাহ করবে।
সভার ব্যাপারে পররাষ্ট্রসচিব শহিদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, “আলোচনার মধ্যে সব বিষয় উঠে এসেছে। এবং দ্রুত যেন প্রত্যাবাসন করা সম্ভব হয় সে জন্য দুপক্ষই এক সাথে কাজ করার চেষ্টা করছি।”
তিনি বলেন, “এ ধরনের প্রত্যাবাসন সব সময়ই জটিল ও কঠিন ব্যাপার। সব পক্ষের মধ্যেই এটা যে হওয়া প্রয়োজনীয় সেব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে হোক এটাও আমরা সবাই অনুভব করছি। এখন যে ধরনের অসুবিধা আছে সেই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করছি। আশা করি আমরা এগুলো দূর করতে পারব।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক পদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, মিয়ানমারের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়, বাংলাদেশ সীমান্তে সামরিক পরিখা খনন করছে কি না।
সীমান্তে পরিখা খনন প্রসঙ্গে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের প্রতিনিধি মিয়ানমারকে জানান, ওই বাঙ্কারগুলো কোনো সামরিক উদ্দ্যেশে খনন করা হয়নি।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের জন্য গত বছর ২৩ নভেম্বর নেপিডোতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ২২ জানুয়ারির মধ্যে শুরু কথা বলা হয়।
চুক্তি অনুসারে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া তদারক করতে গত ১৯ ডিসেম্বর নেপিদোতে ৩০ সদস্যের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠিত হয়।
পররাষ্ট্রসচিব শহিদুল হক ও মিয়ানমারের স্থায়ী সচিব উ মিন্ট থু নিজ নিজ দেশের পক্ষে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন সংক্রান্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
দুদেশের পররাষ্ট্রসচিব জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপে নিজ নিজ দেশের প্রধান।
জানুয়ারি ১৫-১৬ তারিখে নেপিদোতে অনুষ্ঠিত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভা অনুষ্ঠিত হয়।
ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ আট হাজার ৩২ জনের একটি তালিকা মিয়ানমারে কাছে হস্তান্তর করে। তবে পাঁচ মাসে একজন রোহিঙ্গাও রাখাইনে ফিরে যায়নি।