রোহিঙ্গা শিবিরে প্রতিদিন ঘাটতি ৫০ লাখ লিটার পানি
2019.05.20
ঢাকা ও কক্সবাজার

নিরাপদ খাবার পানির সংকটে ভুগছে রোহিঙ্গারা। কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে চাহিদার বিপরীতে প্রতিদিন প্রায় ৫০ লাখ লিটার খাবার পানির ঘাটতি থাকছে।
কক্সবাজার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী পরাগ বড়ুয়া বেনারকে বলেন, “জেলার ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার জন্য দিনে খাবার ও রান্নায় অন্তত ২ কোটি লিটার পানি প্রয়োজন। এর মধ্যে রোহিঙ্গারা পাচ্ছে দিনে ১ কোটি ৫০ লাখ লিটার পানি। শিবিরগুলোতে আরও প্রায় ৫০ লাখ লিটার পানির ঘাটতি রয়েছে।”
সংশ্লিষ্টরা জানান, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় শিবিরে স্থাপিত অগভীর নলকূপগুলো থেকে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। বেসরকারি সাহায্য সংস্থার সরবরাহ করা পানিও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
প্রকৌশলী পরাগ বড়ুয়া বলেন, “গরমের কারণে এই মৌসুমে কক্সবাজারের পানি সংকট লেগে থাকে। তবে ইতিমধ্যে শিবিরগুলোতে পানির অভাব মেটাতে ৬৮টি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের পাইপ প্রকল্পের কাজ চলছে, যা প্রায় শেষের দিকে। এগুলো সম্পূর্ণ হলে পানির অভাব দূর হবে।”
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর জানায়, গত দেড় বছরে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে ১০ হাজার নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ৩ হাজার ১৯২টি ও বাকিগুলো বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা স্থাপন করেছে। এর মধ্যে দুই হাজার অগভীর নলকূপ রয়েছে।
পরিবেশবিদেরা বলছেন, এসব এলাকায় হঠাৎ করে অধিকসংখ্যক নলকূপ স্থাপন, পানির ব্যবহার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া, পাহাড় ও বন উজাড় করে রোহিঙ্গা বসতি স্থাপনের কারণে মাটির নিচে পানির স্তর নেমে গেছে।
কক্সবাজারের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) প্রধান নির্বাহী এম ইব্রাহিম খলিল মামুন বেনারকে বলেন, “মূলত পাহাড়-গাছ নিধন ও অপরিকল্পিত নলকূপ স্থাপনের কারণে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির এলাকায় পানি সংকট দেখা দিয়েছে।”
তবে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ রবিউল হাসান বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা শিবিরে যেনতেনভাবে আরে কোনো নলকূপ স্থাপন করতে দেওয়া হবে না। এখন থেকে পরিকল্পিতভাবে গভীর নলকূপের পাইপ মাটির ৭০০-১০০০ ফুট গভীরে যাবে।”
এসব গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজ শেষ হলে পানির সংকট আর থাকবে না বলে মনে করেন তিনি।
পানির কষ্ট তীব্র
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, শিবিরের প্রতিটি ঘরে তীব্র পানির কষ্ট। পানি সংকটের কারণে সবচেয়ে বেশি ভুগছেন নারী ও শিশুরা।
রোববার টেকনাফের লেদা, শালবাগান মৌচনি ও জাদিমুড়াসহ বেশ কয়েকটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শরণার্থীদের পাইপ থেকে পানি সংগ্রহ করতে প্লাস্টিকের গ্যালন, বালতি ও কলসি নিয়ে দীর্ঘসময় ধরে অপেক্ষা করতে দেখা যায়।
“পানির অভাবে নিয়মিত গোসল করা যায় না, কখনো কখনো রান্না, কাপড় ধোঁয়ার কাজও করতে পারি না,” বৃহস্পতিবার বিকেলে বেনারকে বলেন টেকনাফের মৌচনি রোহিঙ্গা শিবিরে খাবার পানির জন্য অপেক্ষারত রোহিঙ্গা নারী রেহেনা বেগম।
তিনি বেনারকে বলেন, “খাবার পানি আনতে দু-তিন কিলোমিটার দূরের পাশের গ্রামে যেতে হয়। তাও মাঝে মাঝে মেলে না। ফলে আশপাশের খালের পানি ব্যবহার করতে বাধ্য হই।”
মৌচনি রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা জাহেদ উল্লাহ বেনারকে বলেন, তাঁর শিবিরের ১১শ’র বেশি বাসিন্দার জন্য অন্য জায়গায় স্থাপিত ট্যাংক থেকে মাত্র দুটি পাইপের মাধ্যমে পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে অনেকে পানি পায়, অনেকে পায় না। ফলে কাউকে কাউকে ৩-৪ কিলোমিটার দূর থেকে পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। কেউ কেউ পাহাড়ি ছড়ার পানিই ব্যবহার করছে।
তিনি বলেন, “শিবিরের পানি সরবরাহে কোনো নির্ধারিত সময় নেই। এতে প্রয়োজন মতো রোহিঙ্গারা পানি ব্যবহার করতে পারছে না।”
টেকনাফের জাদিমুড়া ক্যাম্পে খালি কলসি হাতে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেও পানি না পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে কিশোরী মিনারা বেগম (১১)। পরে একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী এগিয়ে এসে তাকে পানি নেওয়ার সুযোগ করে দেন।
মিনারা বেনারকে জানায়, “শিবিরের ঝুপড়ি ঘরে অসুস্থ মা আছে। গত তিন ধরে গোসল করাতে পারেনি। তা ছাড়া ঘরে ছোট তিন ভাই-বোনও আছে। এই এক কলসি পানি দিয়ে কষ্ট করে দিন কাটাতে হবে।”
টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য মোহাম্মদ আলী বেনারকে বলেন, “বর্ষা ছাড়া এখানে পানির তীব্র সংকট থাকে। তার উপর বিরাট সংখ্যক রোহিঙ্গা আসায় পানির সংকট আরও বেড়েছে। পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় বেশির ভাগ রোহিঙ্গা শিবিরে পানির অভাবটা বেশি।”
বেড়েছে ডায়রিয়া
টেকনাফ ও উখিয়া প্রশাসনের হিসাবে উখিয়া-টেকনাফের ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গাদের অবস্থান। এদের মধ্যে ৬০ শতাংশই শিশু।
কক্সবাজার সিভিল সার্জন ডা. এমএ মতিন বেনারকে জানান, “ঘনবসতিপূর্ণ রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে দূষিত পানি খাওয়ার কারণে হাজার হাজার রোহিঙ্গার ডায়রিয়া, পেটের পীড়াসহ নানা ধরনের রোগ লেগেই আছে।”
“পানির অভাব দূর হলে এসব রোগ থেকে কিছুটা পরিত্রাণ পেত রোহিঙ্গারা,” বলেন তিনি।
জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্র জানায়, কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩০ আশ্রয় শিবিরে ১৫টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। তার মধ্যে টেকনাফে ৫টি, উখিয়াতে ১০টি।
এসব মেডিকেল টিম গত এক মাসে ৮৭ হাজার ৩২৫ রোগীকে সেবা দিয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় ১৭ হাজার ডায়রিয়ার রোগী। এ ছাড়াও দূষিত পানি খেয়ে অনেকেই অন্যান্য পানিবাহিত রোগেও আক্রান্ত হচ্ছে।