রোহিঙ্গাদের মাথাপিছু খাদ্য সহায়তা আরও কমাল বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি
2023.05.23
ঢাকা ও কক্সবাজার

অর্থ সংকটের কারণে তিন মাসের মধ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য খাবার বরাদ্দ আবারও কমিয়েছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডাব্লিউএফপি)। আগামী ১ জুন থেকে প্রতি শরণার্থীর জন্য মাসিক বর্তমান বরাদ্দ ১০ মার্কিন ডলার থেকে কমিয়ে আট ডলার করার কথা জানিয়েছে সংস্থাটি।
এর আগে চলতি বছরের মার্চে জনপ্রতি মাসিক বরাদ্দ ১২ ডলার থেকে কমিয়ে ১০ ডলার করা হয়।
রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আশঙ্কা করছেন, বরাদ্দ কমানোয় অনেক পরিবারকে না খেয়ে থাকতে হতে পারে। আবার অনেকে বলছেন, বরাদ্দ কমানোর ফলে রোহিঙ্গারা অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়তে পারেন।
খাদ্য সহায়তার অর্থ কমানোর ঘোষণার মধ্যেই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর অংশ হিসাবে আগামী ২৫ মে বাংলাদেশে আসছে মিয়ানমার সরকারের প্রতিনিধিদল।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের রোহিঙ্গা সেলের প্রধান মোঃ হাসান সারওয়ার বেনারকে এই তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, মিয়ানমার প্রতিনিধিদের সাথে প্রত্যাবাসন বিষয়ে আলোচনা করতে রোহিঙ্গাদের প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে।
‘টিকে থাকা কষ্ট হবে’
অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, গত সপ্তাহে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য মাথাপিছু মাসিক খাদ্যের বরাদ্দ বর্তমান ১০ মার্কিন ডলার থেকে আট ডলার করার সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে। কারণ হিসাবে জানান হয়েছে, অর্থ সংকটে বরাদ্দ কমানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, নতুন সিদ্ধান্ত ১ জুন থেকে কার্যকর হবে বলেও জানানো হয়েছে।
সামছু-দ্দৌজা বলেন, “খাদ্য বরাদ্দ কমানো ঠিক হয়নি। তারা অন্য খাতে খরচ কমাতে পারত। খাদ্য বরাদ্দ কমানোর ফলে পুষ্টি, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য প্রাপ্ত অর্থ ডাব্লিউএফপি খরচ করে, সেখানে সরকারের কিছু করার নেই।
বাংলাদেশে অবস্থানকারী ১২ লাখ রোহিঙ্গার খাবারসহ ২০টি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য দেয়া হয় দাতাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অনুদানের মাধ্যমে।
চলতি বছরের খরচ মেটাতে ৮১৭ মিলিয়ন ডলার সাহায্য চাওয়া হলেও অর্থ মিলেছে মাত্র শতকরা ১৭ ভাগ।
অনুদান কমে যাওয়ায় এ বছর ১ মার্চ থেকে ১২ ডলারের পরিবর্তে ১০ ডলার খরচ করছে জাতিসংঘ।
তিন মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো বরাদ্দ কমানোর ফলে রোহিঙ্গারা বিপদে আছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন টেকনাফের লেদা ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম।
তিনি বলেন, “আবার দুই ডলার রেশন কমিয়ে দেওয়ায় রোহিঙ্গারা হতাশ হয়ে পড়বে। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের বাইরে কাজ করার সুযোগ কমেছে। তাই অনেকের ঘরে অভাব দেখা দিয়েছে।”
মোহাম্মদ আলম বলেন, “এই অবস্থায় অনেকে অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।”
টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা শফিকা বেগম বেনারকে বলেন, “আমার ঘরে সাত সদস্য রয়েছে। স্বামী প্রতিবন্ধী। আগে থেকে যে রেশন পাই তা দিয়ে আমাদের অভাব-অনটন লেগে থাকত। এর মধ্যেই আরো রেশন কমিয়ে দেয়া হলে টিকে থাকা কষ্টকর হবে। কারও কাছ থেকে এখন ধারও পাওয়া যাবে না। কারণ সবাই অভাবে থাকবে।”
জাদিমুড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আব্দুর রহিম বলেন, “আমার পরিবারে আটজন সদস্য। আমারা যে রেশন পেতাম তা এমনিতেই অপ্রতুল ছিল। তার ওপর আবারও দুই ডলার কমিয়ে দিচ্ছে। এখন আমাদের না খেয়ে থাকতে হবে।”

মিয়ানমার প্রতিনিধিরা আসছেন
সম্ভাব্য প্রত্যাবাসনকে সামনে রেখে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনা করতে চলতি মাসের ২৫ মে মিয়ানমার প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসছে।
মিয়ানমার প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনায় অংশ নেওয়া টেকনাফের রোহিঙ্গাদের নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকারি কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে টেকনাফে মৌচনি নূরালীপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি মো. আমান উল্লাহ বেনারকে বলেন, “আমরা জেনেছি আগামী ২৫ মে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধি দল আসছে। তাঁরা (মিয়ানমার দল) রোহিঙ্গাদের সাথে বৈঠকে বসার কথা রয়েছে। সম্প্রতি যেসব রোহিঙ্গা মিয়ানমার ঘুরে এসেছেন, তাদের সঙ্গে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে আলোচনা করবেন তারা।”
চীনের মধ্যস্থতায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য রাখাইনে নির্মিত শিবিরগুলো দেখতে বাংলাদেশে আশ্রিতদের মধ্যে যাঁদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাদেরই একজন আবু শামা।
তিনি বেনারকে বলেন, “মিয়ানমার প্রতিনিধিদল দল আসার বিষয়টি আমাদের অবগত করেছেন ক্যাম্প ইনচার্জ। আমাদের সবাইকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। এখানে (টেকনাফে) আসার পর ২৬ নম্বর ক্যাম্প শালবনে আমাদের সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।”
২০১৭ সালের আগস্ট থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফের ৩২টি ক্যাম্পে ১২ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে।
তাদের রাখাইনে ফেরত নিতে প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। চুক্তি স্বাক্ষর করলেও রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে মিয়ানমার।
রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরাতে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হয়েছে একটি ত্রিপক্ষীয় কমিটি।
এই কমিটি দুটি সভা করলেও প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি। একজন রোহিঙ্গাও মিয়ানমার ফেরত যাননি।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে প্রত্যাবাসনে আগ্রহ দেখায় মিয়ানমার। চীনের মধ্যস্থতায় একটি পাইলট প্রকল্পের আওতায় রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করে সরকার।
এর অংশ হিসাবে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধিদল টেকনাফ সফর করে ৪৮০ পরিবারের সাক্ষাতকার গ্রহণ করে।
গত ৫ মে বাংলাদেশ সরকার ও রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধিদল রাখাইন সফর করে।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে শনিবার টেকনাফের কেরুনতলী ট্রানজিট ক্যাম্প সফর করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ফারুক খান বেনারকে বলেন, বাংলাদেশ চায় এই বছরের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচ হাজার রোহিঙ্গাকে রাখাইন ফেরত যাক।
তিনি বলেন, একবার প্রত্যাবাসন শুরু হলে ধীরে ধীরে গতি বাড়বে।