মিয়ানমারের ওপর ‘আন্তর্জাতিক চাপই’ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করার একমাত্র উপায়
2021.05.25
ঢাকা

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমারের সামরিক সরকার প্রধানের সাম্প্রতিক নেতিবাচক মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ বলছে, দেশটির ওপর আন্তর্জাতিক চাপই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার একমাত্র উপায়।
এর আগে বাংলাদেশ ও চীনের কর্মকর্তারা হতাশা প্রকাশ করলেও সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়া নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন খোদ মিয়ানমারের সামরিক সরকার প্রধান মিন অং হ্লাইং।
গত ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের ক্ষমতায় আসা মিন অং হ্লাইং প্রথমবারের মতো ২৩ মে চীনা ভাষার ফনিক্স টেলিভিশন চ্যানেলকে এক সাক্ষাৎকার দেন।
সাক্ষাৎকারে তিনি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ফেরা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, বিষয়টি যদি মিয়ানমারের আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, তাহলে বিবেচনা করার কী আছে?
“আমি বিশ্বাস করি না যে বিশ্বে এমন কোনো দেশ আছে যারা শরণার্থীদের গ্রহণের জন্য নিজের দেশের আইনের বাইরে যেতে পারে,” রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া প্রসঙ্গে বলেন তিনি।
রোহিঙ্গারা সাংবিধানিকভাবে মিয়ানমারে জাতিগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃত নয় বলে জানান মিন অং হ্লাইং।
যদিও গত ফেব্রুয়ারিতে অভ্যুত্থানের পরই তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে। কিন্তু তাঁর ওই ঘোষণার পরও রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর রক্তাক্ত অভিযানের মুখে রাখাইন থেকে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। সেসময় দেশটির সামরিক বাহিনীর প্রধান ছিলেন মিন অং হ্লাইং।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হওয়ায় মঙ্গলবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আন্তর্জাতিক চাপ একমাত্র পথ
মিয়ানমারের সামরিক সরকার প্রধানের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ফারুক খান মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করলেই কেবল দেশটি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হবে।
তিনি বলেন, “মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হবে না। তবে আমরা যদি চীনা সমর্থনকে নিশ্চিত করতে পারি এবং আসিয়ানের মতো আঞ্চলিক গ্রুপের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করতে পারি, তাহলে মিয়ানমার তাদের লোকদের ফিরিয়ে নেবে।”
তাঁর মতে, বাংলাদেশকে মিয়ানমারের সাথেও দ্বিপাক্ষিক উদ্যোগ অব্যাহত রাখতে হবে।
“মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশী এবং তাদের সাথে কূটনৈতিকভাবে যুক্ত থাকতে হবে। যারা ক্ষমতায় থাকুক না কেন, আমাদের মিয়ানমারে সরকারের সাথে কাজ করতে হবে,” বলেন ফারুক খান।
তিনি বলেন, গত ফেব্রুয়ারিতে অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমার “রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে” থাকায় বর্তমানে দেশটি “রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্পর্কে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।”
“মিয়ানমারের সেনাপ্রধান রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্পর্কে যা বলেছেন তা শুনেছি,” জানিয়ে বলেন ফারুক খান বলেন, “অতীতে মিয়ানমারের নেতা ও কর্মকর্তারাও একইভাবে কথা বলেছিলেন। তবে তারা ১৯৭৮ এবং ১৯৯২ সালে আলোচনার মাধ্যমে তাদের জনগণকে গ্রহণ করেছেন।”
“রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্পর্কে মিয়ানমারের সামরিক প্রধানের মন্তব্য নতুন নয়; এটি তাদের পূর্ববর্তী বক্তব্যগুলোর ধারাবাহিকতা। তারা কখনই চায় না যে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাক,” বেনারকে বলেন উখিয়ার কুতুপালংয়ের রোহিঙ্গা নেতা মো. রফিক।
তাঁর মতে, “সত্যিকারের প্রত্যাবাসন তখনই শুরু হবে যখন জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এতে পুরোপুরি যুক্ত থাকবে।”
রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বা নির্বাচিত নেত্রী অং সান সুচি “একই মুদ্রার এপিঠ–ওপিঠ" বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল ইউনিয়নের সেক্রেটারি মাস্টার মো. ইলিয়াস।
মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের বক্তব্য সম্পর্কে মন্তব্য জানতেম পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না বলে বেনারকে জানান।

ভাসানচর ‘বিশ্বের জন্য উদাহরণ’
মঙ্গলবার গণভবনে সফররত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) প্রেসিডেন্ট বোলকান বজকিরের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন শুরু করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সংলাপ ও যোগাযোগ পুনরায় শুরু করতে চায়।
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের ওই বৈঠক সম্পর্কে ব্রিফ করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে আমরা আলোচনায় ছিলাম। যদিও সেখানে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ছিল না।”
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী আবাসনের জন্য ভাসানচরকে প্রস্তুত করার কথাও ইউএনজিএ প্রেসিডেন্টকে জানান শেখ হাসিনা।
এখন পর্যন্ত সেখানে ১৮ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে নেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “ভাসানচরে এক লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে নেওয়া যেতে পারে।”
মানবিক দিক বিবেচনায় বিরাট সংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের প্রশংসা করেন ইউএনজিএ প্রেসিডেন্ট।
দুপুরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে এক যৌথ ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় ভাসানচর “বিশ্বের জন্য উদাহরণ হতে পারে।”
প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি জাতিসংঘ
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে চীনের মধ্যস্থতায় মিয়ানমারের সাথে সর্বশেষ সচিব পর্যায়ের ভার্চুয়াল বৈঠক হয়েছিল জানুয়ারির ১৯ তারিখ। যদিও সেই বৈঠকে কার্যকর কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
এর পরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমারের সাথে আর কোনো আলোচনা হয়নি বলে মঙ্গলবার বেনারকে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা।
যদিও যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার আলোচনায় সমর্থন অব্যাহত রাখার বিষয়ে গত ২১ মে চীনের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই।
তিনি এক টেলিফোন আলোচনায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেনকে এই প্রতিশ্রুতি দেন বলে এক বিবৃতিতে জানায় চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, বেইজিং খুব শিগগির রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে ফের আলোচনা শুরু করতে বাংলাদেশ, চীন ও মিয়ানমারের মধ্যে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
তবে এর আগে গত ১০ মে বাংলাদেশে চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন, সামরিক অভ্যুত্থানের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের কারণে মিয়ানমারের সাথে চীন ও বাংলাদেশ কার্যত রোহিঙ্গা বিষয়ে যোগাযোগ করতে পারছে না।
মিয়ানমারে “পরিস্থিতি উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই,” জানিয়ে লি জিমিং বলেন, “আমাদের ধৈর্য ধরা ছাড়া উপায়ও নেই। অদূর ভবিষ্যতে ত্রিপক্ষীয় আলোচনা আবার শুরুর কোনো সম্ভাবনা দেখছি না।”
এদিকে মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বোলকান বজকির জানান, মিয়ানমার ইস্যুতে জাতিসংঘ দ্বিধাবিভক্ত, তবে মতৈক্যে পৌঁছানোর জন্য আলোচনা চলছে।
মিয়ানমার প্রসঙ্গে জাতিসংঘ একটি “ঐকমত্যে” পৌঁছাতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেন ইউএনজিএ প্রেসিডেন্ট।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. এহসানুল হক বেনারকে বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্পর্কে জাতিসংঘের কাছে বাংলাদেশ যতটুকু আশা করেছিল, “সংস্থাটি তা পূরণ করতে পারেনি।”
এর ওপর মিয়ানমারের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি “রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চরম অনিশ্চয়তার দিকেই ইঙ্গিত করছে,” বলে মনে করেন তিনি।
মঙ্গলবার সকালে দুদিনের সফরে ঢাকা পৌঁছান জাতিসংঘের ৭৫ তম সাধারণ পরিষদের প্রেসিডেন্ট বোলকান বজকির। বুধবার সকালে তাঁর কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে যাবার কথা রয়েছে।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে সুনীল বড়ুয়া।