প্রতি মাসে রোহিঙ্গা শিবিরে জন্ম নিচ্ছে দুই হাজার শিশু
2018.05.29
ঢাকা ও কক্সবাজার

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিভাগের হিসেবে, প্রতি মাসে রোহিঙ্গা শিবিরে জন্ম নিচ্ছে প্রায় দুই হাজার শিশু। আর জাতিসংঘ শিশু তহবিল–ইউনিসেফের হিসেবে প্রতিদিন জন্ম নেওয়া রোহিঙ্গা শিশুর সংখ্যা ৬০।
একইসাথে মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের ধর্ষণের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নারীরাও ইতিমধ্যে সন্তান জন্ম দিতে শুরু করেছেন। তবে ধর্ষিতাদের জন্মদানের কোনো পরিসংখ্যান বাংলাদেশ সরকার বা জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর কাছে নেই।
“প্রতি মাসে উখিয়া-টেকনাফে রোহিঙ্গা শিবিরে প্রায় দুই হাজার সন্তান জন্ম নেয়,” বেনারকে বলেন কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডাক্তার আবদুস সালাম।
“দুই-এক মাসের মধ্যে সন্তান প্রসব করবেন এমন আরো প্রায় ৩০ হাজার নারী গর্ভবতী রয়েছেন,” যোগ করেন তিনি।
সিভিল সার্জন জানান, সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় মা বা নবজাতকের মৃত্যুর কোনো হিসাব তাঁদের কাছে নেই। পাশাপাশি, ধর্ষণের শিকার হয়ে কতজন নারী সন্তান জন্ম দিয়েছেন বা দেবেন সেই পরিসংখ্যানও নেই।
একইভাবে “রোহিঙ্গা শিবিরে শিশু জন্ম ও মৃত্যুর হিসাব আমাদের কাছে নেই,” বলে বেনারকে জানান আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা-আইওএম এর জাতীয় যোগাযোগ কর্মকর্তা শিরিন আকতার।
এদিকে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে প্রতিদিন গড়ে ৬০টি শিশুর জন্ম হচ্ছে বলে গত ১৭ মে এক বিবৃতিতে জানায় ইউনিসেফ। তাদের হিসেবে ৯ মাস আগে রাখাইন রাজ্যে নতুন করে সংকট শুরুর পর থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১৬ হাজারের বেশি শিশুর জন্ম হয়েছে।
তবে রাখাইন রাজ্যে ধর্ষিতা রোহিঙ্গা নারীদের মধ্যে কতজন সন্তান জন্ম দিয়েছেন বা দেবেন তা জানা ‘অসম্ভব’ বলে ওই বিবৃতিতে জানায় ইউনিসেফ।
বাংলাদেশের একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে গত ১৭ মে বলা হয়, রোহিঙ্গা শিবিরে গর্ভবতী নারীদের বেশির ভাগেরই বয়স ১৮ বছরের নিচে।
ধর্ষিতাদের সন্তান, মেনে নিচ্ছে না সমাজ
কক্সবাজারের টেকনাফ শামলাপুর আছর বনিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরের মাঝি আলী হোসেন বেনারকে জানান, “মিয়ানমারে ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নারীরা ইতিমধ্যে শিশু জন্ম দিতে শুরু করেছেন।”
তিনি বলেন, “আমাদের শিবিরে গত এক সপ্তাহে আশ্রয় নেওয়া আট রোহিঙ্গা নারী সন্তান জন্ম দিয়েছেন।”
রাখাইন থেকে পালিয়ে টেকনাফের লেদার তুলাবাগান রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নেন আজেরা বেগম। তিনি বেনারকে বলেন, “মিয়ানমারে সেনারা আমাকে ধর্ষণ করায় অন্তঃসত্ত্বা হই। বাংলাদেশে আসার পর গত মাসের শেষে দিকে একটি মেয়ে সন্তান জন্ম দিয়েছি।”
“কিন্তু শিশুটির জন্মের পর আমার পরিবার ও সমাজে বিভক্তি দেখা দেয়। আমি স্বামীকে বোঝানোর চেষ্টা করি, আমি ধর্ষণ ও অন্যায়ের শিকার,” বলেন আজেরা।
তিনি বলেন, “নৃশংসতার ফলে পৃথিবীতে আসা শিশুটির কোনো দোষ নেই। কিন্তু তারপরও শিশুটিকে কেউ স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না।”
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তিন সদস্যের হাতে ধর্ষণের শিকার হয়ে নভেম্বরের পালিয়ে এসে এ শিবিরে আশ্রয় নেন রাখাইনের উডং গ্রামের রোহিঙ্গা নারী রুবাইদা বেগম (ছদ্মনাম)।
তিনি বেনারকে বলেন, “এক সপ্তাহ আগে খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে আমাকে বাংলাদেশ জার্মান সম্প্রীতি সংস্থার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একটি ছেলে সন্তানের জন্ম দিলেও কিছু সময় পর শিশুটি মারা যায়।”
ধর্ষণের শিকার হয়ে উখিয়া মধুরছড়া রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন আরেক রোহিঙ্গা নারী সকুরা বেগম (ছদ্মনাম)।
তিনি বেনারকে বলেন, “সাত মাস আগে সেনাদের হাতে ধর্ষণের শিকার হই। তারা আমার স্বামী দিলু আলমকে হত্যা করে। এরপর দুই সন্তান নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসি।”
“তত দিনে ধর্ষণের ফলে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ি। চিকিৎসকের কাছে গেলে আমাকে জানানো হয়, এখন সন্তান নষ্ট করলে আমার জীবনের ঝুঁকি তৈরি হবে। দুই সপ্তাহ আগে ঝুপড়ি ঘরে যমজ কন্যা সন্তানের জন্ম দেই, একটি নবজাতক মারা গেছে,” জানালেন সকুরা বেগম।
টেকনাফ উপজেলার লেদা, উনচিপ্রাং, শামলাপুর, শীলখালী, নয়াপাড়া মৌচনি, উখিয়ার মধুরছড়া রোহিঙ্গা শিবিরের বেশ কয়েকজন নেতা জানান, ধর্ষণের শিকার বেশ কিছু রোহিঙ্গা নারী ইতিমধ্যে সন্তান প্রসব করেছেন।
বাংলাদেশ জার্মান সম্প্রীতি সংস্থা (বিজিএস) ও মেডিসিনস স্যানস ফ্রন্টিয়ারস (এমএসএফ) এর তথ্য মতে, চলতি মাসে ২৪ মে পর্যন্ত ৫৫০ জন রোহিঙ্গা নারীকে তাঁরা চিকিৎসা দিয়েছেন। যার মধ্যে দেড় শতাধিক রাখাইনে যৌন সহিংসতার শিকার রয়েছেন এবং ১৫০ জন গর্ভবতী।
সংস্থাটি জানায়, এমন হাজারো নারী আছেন, যারা যৌন সহিংসতার শিকার হয়ে সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে সাহায্য নিতে আসেননি। এসব নারীরা বাসায় গর্ভপাতের চেষ্টা চালিয়েছেন বলে ধারণা করা হয়।
বিজিএস’র কর্মকর্তা ডা. মুমিনুর রহমান বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা শিবিরে এমন অনেক গর্ভবতী নারী লজ্জায় চিকিৎসা নিতে আসেননি। তবে আমাদের লোকজন তাঁদের খুঁজে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে,” বলেন তিনি।
মিয়ানমারে ধর্ষণের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা নারীরা সামাজিক লজ্জার কারণে অনেকে গর্ভপাতের মাধ্যমে সন্তান নষ্ট করে দিয়েছে—এই তথ্য জানিয়ে টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আজিজ উদ্দিন বেনারকে বলেন, সন্তান জন্ম দেওয়া নারীদের অনেকেই সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন। পাশাপাশি হতভাগা মায়েরা তাঁদের শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তার মধ্যে রয়েছেন।
কক্সবাজার ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম বলেন, “রোহিঙ্গা শিবিরে কতজন ধর্ষিত নারী সন্তান জন্ম দিয়েছেন তার সঠিক হিসাব আমাদের কাছে নেই। তবে এসব সন্তানদেরও আদালতের সহযোগিতার মাধ্যমে প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা হবে।”
গত ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত সাত লাখ রোহিঙ্গা এলেও এ মুহূর্তে উখিয়া ও টেকনাফের ৩০টি শিবিরে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে। বহিরাগমন বিভাগ ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত ১১ লাখ ১৭ হাজার রোহিঙ্গার নিবন্ধন শেষ হয়েছে।