রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘ-মিয়ানমার চুক্তির সম্মতি ইতিবাচক: শরণার্থী কমিশনার

কামরান রেজা চৌধুরী
2018.06.01
ঢাকা
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য নির্মাণ করা মালয়েশিয়ান ফিল্ড হাসপাতালের বাইরে হিন্দু নারীরা স্বাস্থ্যসেবা নিতে অপেক্ষা করছেন। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য নির্মাণ করা মালয়েশিয়ান ফিল্ড হাসপাতালের বাইরে হিন্দু নারীরা স্বাস্থ্যসেবা নিতে অপেক্ষা করছেন। ২৩ জানুয়ারি ২০১৮।
কামরান রেজা চৌধুরী/বেনারনিউজ

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরে মিয়ানমার রাজি হওয়ার ঘটনাটিকে ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ।

এ প্রসঙ্গে শরণার্থী ত্রাণ ও পূনর্বাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম শুক্রবার বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর সাথে কাজ করে যাচ্ছে। জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর সাথে মিয়ানমারের চুক্তি স্বাক্ষর বিলম্বিত হচ্ছিল। অবশেষে তারা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরে রাজি হয়েছে। আমরা মনে করি এটি একটি ইতিবাচক অগ্রগতি।”

তিনি বলেন, “এটা নিশ্চিত যে ইউএনএইচসিআর ও ইউএনডিপির সাথে মিয়ানমারের এই চুক্তি প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে সহজ করবে।”

বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমার ইউএনডিপি ও ইউএনএইচসিআর এর সাথে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারকের খসড়া চূড়ান্ত করেছে বলে বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে জানায় ইউএনএইচসিআর।

এতে বলা হয়, নিরাপদ প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইনের পরিস্থিতির উন্নয়নে এই সমঝোতা স্মারক একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।

বিবৃতিতে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের কোনো তারিখ না জানালেও এর ফলে রাখাইন রাজ্যে জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর প্রবেশাধিকারের পথও উন্মুক্ত হবে বলে মন্তব্য করা হয়।

একই সাথে পৃথক এক বিবৃতিতে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলরের দপ্তরও বৃহস্পতিবার এই সমঝোতার বিষয়টি নিশ্চিত করে “শিঘ্রই এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে” বলে জানায়।

বিশেষ ১২২২ জনকে ফেরত নিতে চায় মিয়ানমার

প্রত্যাবাসনে ইচ্ছুক সব রোহিঙ্গাকেই মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের যাচাইর মাধ্যমে যেতে হবে বলে দেশটি বারবার শর্ত দিলেও কোনো এক ‘রহস্যজনক’ কারণে বিশেষ ১ হাজার ২২২ জনকে যাচাই বাছাই ছাড়াই দেশটি ফিরিয়ে নিতে চায় বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদন।

রোহিঙ্গাদের পূনর্বাসনে সরকারের নেওয়া ব্যবস্থা সম্পর্কে অবহিত করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যদের কাছে গত বৃহস্পতিবার পাঠানো হয়েছে ওই প্রতিবেদনটি। বেনারের কাছে প্রতিবেদনটির একটি কপি রয়েছে।

এতে বলা হয়, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরকালে ৮ হাজার ৩২ জন রোহিঙ্গার একটি তালিকা মিয়ানমার কর্তৃক ভেরিফিকেশনের জন্য হস্তান্তর করা হয়েছে। এ পর্যন্ত মিয়ানমার ১ হাজার ৪৫ জনের ভেরিফিকেশন সম্পন্ন করেছে।

“তবে এই তালিকা বহির্ভূত ৪৪৪ জন হিন্দু এবং ৭৭৮ জন মুসলিমকে মিয়ানমার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রত্যাবাসন করার বিষয়ে একাধিকবার আগ্রহ দেখাচ্ছে,” উল্লেখ করা হয় ওই প্রতিবেদনে।

শরণার্থী ত্রাণ ও পূনর্বাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম শুক্রবার বেনারকে বলেন, প্রত্যাবাসনের কথা উঠলেই প্রত্যাবাসীদের নাম–ঠিকানা ভেরিফাই করার কথা বলে মিয়ানমার। এমনকি সীমান্তের শূণ্যরেখায় তাদের ভূখণ্ডে আটকে পড়া নাগরিকদের প্রত্যাবাসন প্রসঙ্গেও তারা ভেরিফিকেশনের কথা বলেছিল।

“আমাদের দেওয়া ৮ হাজার ৩২ জনের তালিকার বাইরে অন্যদের ভেরিফিকেশন ছাড়াই ফিরিয়ে​ নেওয়ার প্রস্তাব সত্যিই রহস্যজনক,” বলেন আবুল কালাম।

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের বালুখালী শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা আমিনুল ইসলাম টেলিফোনে বেনারকে বলেন, “আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা মিয়ানমার সরকারের এজেন্ট। তারা রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। আবার এখানে এসেও তারা মিয়ানমার সরকারের কাছে তথ্য পাচার করে।”

তিনি বলেন, “মিয়ানমার সরকার যাদের ভেরিফেকেশন ছাড়াই ফিরিয়ে নিতে চায় তারা মূলত তাদের লোক। তা না হলে লাখ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে কিছু মানুষকে ফিরিয়ে নিতে এত আগ্রহ কেন?”

গত বছর ২৫ আগস্ট জঙ্গিগোষ্ঠী আরসার আক্রমণে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য নিহত হলে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে অভিযান শুরু করে। জীবন বাঁচাতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এখন পর্যন্ত ১১ লাখ রোহিঙ্গা রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এদের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা এসেছে গত বছর ২৫ আগস্টের পর। এ ছাড়া বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে মিয়ানমার অংশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ছয় হাজারের বেশি।

জিরো লাইনে বসবাস করা রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ বেনারকে বলেন, “আমাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের কর্মকর্তারা আমাদের সাথে কথা বলে গেলেন। কিন্তু কয়েক মাস পার হয়ে গেলেও আমাদের গ্রামে ফিরে যেতে দেওয়া হয়নি।

উখিয়ায় অবস্থানকারী হিন্দু শরণার্থীদের একজন সুবাস রুদ্র টেলিফোনে বেনারকে বলেন, “আমরা এখানে নিরাপদ আছি। কিন্তু এখানে কোনও কাজ নেই। বসে থাকতে হয়। প্রতিদিন ডাল দিয়ে ভাত খাওয়া যায় না। আমরা আমাদের গ্রামে ফিরে যেতে চাই।”

তিনি বলেন, “আমরা সরকারের কাছে আবেদন করছি আমাদের যেন নিজ গ্রামে ফিরতে দেওয়া হয়।”

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়, ১৭ মে বাংলাদেশ-মিয়ানমার জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের দ্বিতীয় সভা ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে মিয়ানমার সরকার কর্তৃক কোনও পদক্ষেপ না নেওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়।

অতি দ্রুত প্রত্যাবাসন শুরুর লক্ষ্যে রাখাইন রাজ্যে সাম্ভাব্য প্রত্যাবাসনকারীদের নিরাপত্তা, জীবিকা এবং অবাধ চলাচলের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মাধ্যমে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানায় বাংলাদেশ।

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বিষয়ে ‘অজ্ঞাত’ রোহিঙ্গারা

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার বিস্তারিত বিষয়ে রোহিঙ্গাদের অর্ধেকই প্রায় কিছুই জানেন না বলে তথ্য উঠে এসেছে সাম্প্রতিক এক জরিপ প্রতিবেদনে।

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সম্পর্কে রোহিঙ্গাদের ধারণা কতটুকু পরিষ্কার তা জানার জন্য গত এপ্রিল-মে মাসে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে থাকা ১,৭০৩ জন রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করে এক্সচেঞ্জ ফাউন্ডেশন।

“উত্তরদাতাদের মাত্র অর্ধেক প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যকার চুক্তির কথা শুনেছেন,” জানিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, “এ বিষয়ে যতটুকু তথ্য পেয়েছেন তাতে ৮০ ভাগ উত্তরদাতাই সন্তোষ্ট নন।”

“শতকরা ৯৭ ভাগ রোহিঙ্গা স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে থাকতে চান না,” জানিয়ে গত ২৩ মে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়, “তবে প্রায় সবাই ফেরার কথা ভাববেন, যদি কিছু পূর্বশর্ত পূরণ করা হয়।”

রোহিঙ্গাদের দেওয়া প্রত্যাবাসনের পূর্বশর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে, মিয়ানমারে নাগরিকত্বের স্বীকৃতি, স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলো।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।