রোহিঙ্গাদের সমর্থন চায় মিয়ানমারের বিকল্প সরকার: মিশ্র প্রতিক্রিয়া

কামরান রেজা চৌধুরী ও সুনীল বড়ুয়া
2021.06.04
ঢাকা ও কক্সবাজার
রোহিঙ্গাদের সমর্থন চায় মিয়ানমারের বিকল্প সরকার: মিশ্র প্রতিক্রিয়া মিয়ানমারের রাখাইনে রাজধানী সিত্তের কাছে বওদুপায় অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত শিবিরে চিকিৎসার জন্য অপেক্ষা করছেন কয়েকজন রোহিঙ্গা। ২ নভেম্বর ২০১২।
[এএফপি]

মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে রোহিঙ্গাদের সমর্থন চেয়েছে সামরিক বাহিনীর হাতে ক্ষমতাচ্যুত ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) নামে পরিচিত অং সান সূচি সমর্থিত সরকার। 

রোহিঙ্গাদের ওপর ঘটে যাওয়া নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের বিচারের আশ্বাস দিয়ে এনইউজি বলেছে, তারা ক্ষমতায় গেলে রোহিঙ্গাদের হারানো নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে দেবে। এ ছাড়া ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন বাতিল করবে, যার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছিল। 

বৃহস্পতিবার টুইটারে দেয়া এক বিবৃতিতে এই আশ্বাস দেয়া হয়।

গত কয়েক দশকে এই প্রথমবারের মতো মিয়ানমারের কোনো রাজনৈতিক জোটের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের পক্ষে এটিই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিবৃতি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এই প্রথমবারের মতো ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটিও ব্যবহার করেছে তারা। 

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ফরটিফাই রাইটস এর প্রধান নির্বাহী ম্যাথিউ স্মিথ এক বিবৃতিতে বলেছেন, “সমগ্র মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য এটি একটি বিরাট মুহূর্ত। এই নতুন নীতি ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ের ভিত্তি হিসাবে কাজ করবে এবং এর ফলে মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার পথ সুগম হবে।”

এনইউজি বিবৃতিতে বলা হয়, “সামরিক বাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে নির্যাতন ও সহিংসতা ঘটে গেছে সেব্যাপারে বার্মার সমগ্র জনগণ সমব্যথী।”

এতে বলা হয়, “রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী যে অপরাধ করেছে সেগুলোর বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে কাজ করবে এনইউজি।”

এছাড়া রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা বিতর্কিত জাতীয় যাচাইকরণ কার্ড (এনভিসি) তারা বাতিল করবে বলেও জানিয়েছে বিবৃতিতে। 

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে এনভিসি একটি বড়ো অন্তরায়। মিয়ানমার সরকার বলেছে, রোহিঙ্গাদের ফিরতে এনভিসি নিতে হবে যা বিদেশিদের জন্য প্রযোজ্য। তাই রোহিঙ্গারা এই কার্ড নিতে চান না।

মিয়ানমারের পূর্ব নাম বার্মা। দেশটিতে বর্তমানে সাংবিধানিকভাবে ১৩৫টি জাতি গোষ্ঠী রয়েছে। রোহিঙ্গারা সেখানে কোনো জাতিগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃত নয়।

মিয়ানমারের উত্তর রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানরা শত শত বছর ধরে বসবাস করলেও দেশটির সকল রাজনৈতিক দল ও সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের অবৈধ বাংলাদেশি বলে আখ্যায়িত করে থাকে।

১৯৮২ সালে জেনারেল নে উইনের আমলে জারি করা নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। এরপর থেকে তাঁরা তাঁদের গ্রামের বাইরে বের হতে পারেন না।

রোহিঙ্গাদের ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে মিয়ানমারের সবচেয়ে বড়ো দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমক্র্যাসিসহ (এনএলডি) কোনো রাজনৈতিক দলই তাঁদের পক্ষে কথা বলে না। উল্টো তারা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার জন্য সামরিক বাহিনীকে প্রশংসা করে থাকে।

এনএলডি নেত্রী ও সরকার প্রধান অং সান সূচি নিজেও ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা নিধনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে সামরিক বাহিনীকে সমর্থন করে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে কথা বলেছেন। 

রোহিঙ্গাদের আস্থা অর্জনে ‘অনেক কিছু করতে হবে’

গত বছর নভেম্বর সাধারণ নির্বাচনে এনএলডি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে কারচুপির অভিযোগ এনে ক্ষমতা গ্রহণ করে সামরিক বাহিনী।

এনএলডি নেতা–কর্মীরা রাস্তায় বিক্ষোভ করলেও সামরিক বাহিনী দমন অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। 

এই প্রেক্ষাপটে এনএলডি মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের সাথে নভেম্বরের নির্বাচনে জয়ী সাংসদদের নিয়ে গঠন করেছে ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি)। তাঁরা সারা বিশ্বে মিয়ানমারের সেনা সরকারকে হটাতে কাজ করে চলেছে।

এরই অংশ হিসাবে তারা বাংলাদেশে আশ্রিত ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গাদের সমর্থন কামনা করছে। বিবৃতি প্রকাশের আগে কক্সবাজারের থাকা রোহিঙ্গাদের সাথে আলোচনাও করেছে। 

“আমাদের সাথে অনলাইনে ন্যাশনাল ইউনাইডেট নেতৃবৃন্দের দফায় দফায় সভা হয়েছে। আমরা তাদের কাছে দাবি করেছিলাম, আগে অন্তত একটা বিবৃতি প্রকাশ করা হোক। এর ধারাবাহিকতায় তারা এটা দিয়েছে,” শুক্রবার বেনারকে বলেন কক্সবাজারের আরাকান ন্যাশনাল ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাস্টার মো. ইলিয়াছ।

তিনি বলেন, “তাদের এ বিবৃতিকে আমরা সতর্কতার সাথে স্বাগত জানাই, যদিও অতীতে রোহিঙ্গারা পদে পদে তাদের বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছে।”

“তবে যেহেতু তারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলছে, রোহিঙ্গাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে কাজ করবে বলেছে, সেহেতু এনইউজি-তে অবশ্যই রোহিঙ্গা প্রতিনিধি এবং রোহিঙ্গা নেতৃবৃন্দকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে,” বলেন ইলিয়াছ।

তিনি বলেন, “যুগ যুগ ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যা ও নির্যাতন চালিয়ে আসছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও মগেরা। এই গণহত্যার কারণে লাখ লাখ রোহিঙ্গা দেশ ছেড়ে বর্তমানে বাংলাদেশ, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন আশ্রয় নিয়েছে।” 

তাই তাঁর মতে, “এনইউজি-তে আমাদের নেতাদের যুক্ত করলে রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা সহজ হবে। এবং এই সরকারের প্রতি রোহিঙ্গাদের পুরোপুরি বিশ্বাস আসবে।”

ইলিয়াস আরও বলেন, “তারা বলেছে, নাগরিকত্ব, রোহিঙ্গাকে জাতি হিসাবে স্বীকৃতিসহ রোহিঙ্গাদের যেসব অধিকার সামরিক সরকার কেড়ে নিয়েছে সেগুলো তারা ফিরিয়ে দিতে কাজ করবে।”

এনইউজি’র এই বিবৃতিকে “রোহিঙ্গাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ,” হিসেবে আখ্যায়িত করে বান্দরবানের ঘুমধুম কোনারপাড়ার নোম্যানস ল্যান্ডের রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার দীল মোহাম্মদ বেনারকে বলেন, “সবকিছু মিলিয়ে বিষয়টি রোহিঙ্গাদের জন্য ইতিবাচক মনে হচ্ছে।” 

তবে তাঁর মতে, “এনইউজি’র এসব সিদ্ধান্ত মগ সম্প্রদায় মেনে নেবে না। কারণ সামরিক বাহিনীর সাথে মিলে মগেরাও রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে।” 

এনইউজি’র বিবৃতি সম্পর্কে বেনারের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার অনুবিভাগের মহাপরিচালক মো. দেলোয়ার হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি। 

রোহিঙ্গাদের অধিকারের স্বীকৃতি সংক্রান্ত এনইউজি’র বিবৃতিকে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির বেনারকে বলেন, রোহিঙ্গাদের আস্থা অর্জনের জন্য এনইউজিকে আরো অনেক কিছু করতে হবে। 

“রোহিঙ্গা ও বৌদ্ধদের মধ্যে গত কয়েক দশকের তিক্ততার কথা বিবেচনা করে বলতে হয়, রোহিঙ্গাদের আস্থা অর্জন করতে আরও অনেক কিছু করতে হবে এনইউজি'র’র পক্ষ থেকে। রোহিঙ্গারা এত সহজে এটি বিশ্বাস করবে না।,” বলেন হুমায়ূন কবির।

কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “আমরা দেখেছি অং সান সূচি তাঁর রাজনৈতিক সুবিধার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র হয়ে রোহিঙ্গাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।”

তবে তাঁর মতে, মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে উৎখাত করতে পারলে এনইউজি হয়ত ক্ষমতায় আসবে। তখন “রোহিঙ্গারা তাদের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার ফিরে পেতে পারে।” 

rohingya.jpg

চার মাস সাগরে ভেসে ৮১ রোহিঙ্গা ইন্দোনেশিয়ায়

প্রায় চার মাস সাগরে ভেসে থাকা মিয়ানমারের ৮১ রোহিঙ্গা শুক্রবার ইন্দোনেশিয়ার তীরে পৌঁছেছেন। তাঁদেরকে দেশটিতে আশ্রয় দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

এই শরণার্থীরা আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের কাছে দীর্ঘদিন নৌকায় আটকে থাকলেও ভারত অথবা মালয়েশিয়া কেউ তাঁদের তীরে ভিড়তে দেয়নি।

এর আগে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর ওই শরণার্থীরা কক্সবাজার থেকে গত ১১ ফেব্রুয়ারি সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবার কথা জানিয়েছিল।

তবে নৌকার রোহিঙ্গাদের বরাত দিয়ে ইন্দোনেশিয়ার সরকারি বার্তাসংস্থা আনতারা শুক্রবার জানিয়েছে, দলটি মূলত মিয়ানমার থেকে রওয়ান দিয়েছিল। 

রওয়ানা দেবার ১১৩ দিন পর তীরে ভিড়ল দলটি। দলটিতে ৪৯ জন পুরুষ, ২১ জন নারী ও ১১টি শিশু রয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের একজন সরকারি কর্মকর্তা ইদ্রিস। তাঁরা সবাই সুস্থ রয়েছেন বলেও জানান তিনি।

মোট ৯০ শরণার্থীর মধ্যে সাগরে ভাসমান অবস্থায় নয় জন মারা যান বলে নৌকার এক রোহিঙ্গা মোহাম্মদ ইলিয়াসের বরাতে জানায় আনতারা।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন জাকার্তা থেকে রিজা খাদিজা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।