আশ্রয় মিললেও জীবিকার অনিশ্চয়তা কাটেনি রোহিঙ্গাদের

জেসমিন পাপড়ি
2017.06.07
ঢাকা
ক্যাম্পের আশপাশে নতুন কাউকে দেখলে সাহায্যের আশায় এভাবেই ঘিরে ধরে রোহিঙ্গা শিশুরা। ক্যাম্পের আশপাশে নতুন কাউকে দেখলে সাহায্যের আশায় এভাবেই ঘিরে ধরে রোহিঙ্গা শিশুরা। উখিয়া, কক্সবাজার। জুন ০২, ২০১৭।
জেসমিন পাপড়ি/বেনারনিউজ

কয়েক মাস ধরে বসবাস করলেও জীবিকার অনিশ্চয়তা ও অপর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তার কারণে ভিক্ষা করেই চলছে মিয়ানমার থেকে সম্প্রতি প্রাণভয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া অনেক রোহিঙ্গার জীবন।

“গত পাঁচ মাসে একবার ২৫ কেজি চাল পেয়েছি। আর কিছুই না। বৃদ্ধ স্বামী আর শিশু দুই নাতিকে নিয়ে চারজনের সংসার। এদের কেউই আয় করতে পারে না। তাই ভিক্ষা করে চলি,” কথাগুলো বলছিলেন রোহিঙ্গা নারী সোনা মেহের (৬০)।

কক্সবাজার জেলার উখিয়ার কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরে বসবাস তাঁর। গত বছরের অক্টোবরে ছেলে আর তার বউকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী হত্যা করলে নাতিদের নিয়ে পালিয়ে আসেন সোনা মেহের দম্পতি।

কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের পাশে সোনা মেহের যেখানে থাকেন সেই জমিতে ৯০টি নতুন পরিবারের বসবাস। ঘর বলতে বাঁশের বেড়ায় পলিথিন দিয়ে ঘেরা। তবুও মাস প্রতি পাঁচ শ টাকা ভাড়া দিতে হয়।

গত সপ্তাহে কক্সবাজারের দুটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে জানা যায় কুতুপালাং এর প্রায় সাড়ে চার শ বাসিন্দার অনেকেই সোনা মেহেরের মতো গত ৫-৬ মাসে মাত্র একবার বেসরকারি ত্রাণ সহায়তা পেয়েছেন।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম), বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এবং আরও কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা ত্রাণ সহায়তা দিলেও তা নিয়মিত নয় বলে অভিযোগ অনেকের। তবে এসব সংস্থার প্রতিনিধিরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের সাধ্যমতো সহায়তা করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে আইওএম’র কক্সবাজার সাব–অফিসের প্রধান সংযুক্তা সাহানি বেনারকে বলেন, “সকল রোহিঙ্গা, বিশেষ করে যারা নতুন এসেছে তাদের সহায়তা দেওয়ার জন্য ডব্লিউএফ‌পি খুবই চেষ্টা করেছে। আগে শুধু চাল দেওয়া হতো। এখন হাই এনার্জি বিস্কুট দিচ্ছে।”

এ প্রসঙ্গে অভিবাসন ও শরণার্থী বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বেনারকে বলেন, “(রোহিঙ্গাদের) অনেকেই বাইরে কাজ করে থাকে। সে আয় দিয়ে তারা চলতে পারে। তবে ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা টানা বর্ষার দিন গুলোতে রোহিঙ্গাদের প্রতিটি ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়া জরুরি। কারণ, এ সময় তারা কাজ পায় না।”

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক কাজী আবদুর রহমান বেনারকে বলেন, “নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতি মাসে ত্রাণ দেয় ইউএনএইচসিআর। তবে অনিবন্ধিতদের জন্য সরকারে বিশেষ কোনো নির্দেশনা নেই।”

প্রসঙ্গত, গত বছরের ৯ অক্টোবরের পর নাফ নদী পেরিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। জাতিসংঘের মতে, এই সংখ্যা প্রায় ৭৫ হাজার। তবে সম্প্রতি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) গোপনীয় প্রতিবেদনে এই সংখ্যা ৪৮ হাজার ৮৮৩ বলা হয়েছে। এ ছাড়া সরকারের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখ৷

ক্ষুধা মেটানোই বড় চ্যালেঞ্জ

সরেজমিনে টেকনাফ ও উখিয়ার কয়েকটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে দেখা যায়, কারও ঘরে চাল নেই, কেউ কেউ পেট চালাতে ভিক্ষা করছে। পলিথিনের ঘরে থেকে নানা ধরনের রোগে ভুগলেও বড় কোনো অসুখ না হলে হাসপাতালমুখো হয় না তারা। শিক্ষার চিন্তা ওরা করেই না।

কথা হয় সেতারা বেগমের সঙ্গে। কয়েক মাস আগে এক সাক্ষাৎকারে বেনারের কাছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে ধর্ষিত হওয়ার বর্ণনা দিয়েছিলেন তিনি।

রান্নার জন্য কাঁঠালের বিচি প্রস্তুত করছেন এক রোহিঙ্গা নারী। উখিয়া, কক্সবাজার। জুন ০২, ২০১৭।
রান্নার জন্য কাঁঠালের বিচি প্রস্তুত করছেন এক রোহিঙ্গা নারী। উখিয়া, কক্সবাজার। জুন ০২, ২০১৭।
জেসমিন পাপড়ি/বেনারনিউজ
সেই সেতারা এবার শোনালেন এ দেশে এসে প্রতিদিন বেঁচে থাকার আরেক যুদ্ধের কথা।

তিনি বলেন, “মিয়ানমার আর্মির নির্যাতনে আমার স্বামী অসুস্থ হওয়ায় কোনো কাজ করতে পারে না। প্রতি মাসে ২৫ কেজি চাল পাই। কিন্তু এ চাল দিয়ে সংসার চলে না। মাছ কেনার জন্য টাকা নাই। কখনো শুধু দুধ বা পানি দিয়ে সেহেরি খাই। আর সন্ধ্যায় পানি দিয়ে ইফতারি করি।”

কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরে বসবাস করছেন নুর জাহান। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে স্বামীকে হারিয়ে মংডুর নাইসাপ্রো নোরাবিল গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা ৩১ বছরের এই নারীর নির্যাতিত হওয়ার কথাও তুলে ধরেছিল বেনার নিউজ। এক সন্তানসহ একটি ঘরে আশ্রয় মিললেও সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ তার সে ঘর ভেঙে দিয়েছে।

“নতুন ঘর তোলার টাকা নেই। তাই অন্যের ঘরে আশ্রয় নিয়েছি,” জানালের নূর জাহান।

বাংলাদেশে আসার পর থেকে মাত্র একবার ত্রাণ সহায়তা পাওয়ার কথা জানালেন খুরশিদা বেগম (৬০)। তিনি বেনারকে বলেন, “একবার মালয়েশিয়া থেকে আসা ত্রাণ পেয়েছিলাম, আর কিছুই পাইনি। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভাই মনসুর আলীকে (৫৩) দেখিয়ে তিনিও পাননি বলে জানান খুরশিদা।

“দুই দিন আগে একটা বিস্কুটের কার্টুন পেয়েছি। সেখানে ৫০ পিস ছোট বিস্কুটের প্যাকেট রয়েছে। এখন শুধু বিস্কুট নিয়ে ইফতারি করি,” বেনারকে জানান টেকনাফের লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সেনোয়ারা বেগম (২০)।

প্রতিমাসে ২৫ কেজি চাল পাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, বড় সংসার। এই চালে হয় না।

কিছুটা ভিন্ন চিত্র নিবন্ধিত ক্যাম্পে

মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের বড় অংশকেই শরণার্থী স্বীকৃতি দেয়নি বাংলাদেশ। দুটি নিবন্ধিত ক্যাম্পে স্বীকৃত শরণার্থী সংখ্যা মাত্র ৩৪ হাজার। সরকারের অনুমতিতে তাদের আর্থিক সহায়তা করে থাকে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা-ইউএনএইচসিআর।

এখানকার পরিবারগুলোকে সদস্যপ্রতি ৮৫০ টাকা করে দেওয়া হয়। এরা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে বসবাস করায় স্থানীয়ভাবেও তারা কাজ কর্ম করেন।

নয়াপাড়া নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা নুর নাহার বেগম বেনারকে বলেন, “ছয় সন্তানসহ আমার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৮। জনপ্রতি ৮৫০ টাকা হারে মাসে ৬ হাজার ৪০০ টাকা পাই। এর মধ্যে প্রতি মাসে প্রায় ৫ হাজার টাকার শুধু চাল কিনতে হয়। তা দিয়ে কোনো মতে চলি ।”

“তবে তারা (ইউএনএইচসিআর) চিকিৎসা খরচ বহন করে। এমনকি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাচ্চাদের পড়ালেখার ব্যবস্থাও করে। এ কারণে অনিবন্ধিতদের চেয়ে আমরা অনেকটাই ভালো আছি,” বলেন তিনি।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আবদুর রহমান

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।