উদ্বাস্তু জীবনে লাখো রোহিঙ্গা কাটাবেন নিরানন্দ ঈদ
2018.06.08
ঢাকা ও কক্সবাজার

ঈদ দরজায় কড়া নাড়লেও মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় এই উৎসবের কোনো আয়োজন নেই কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে। রাখাইনে মিয়ানমার সেনাদের চালানো নির্যাতনের বিভীষিকা আর অভাবের দাপটে এই উৎসবের রং সেখানে অনেকটাই বিবর্ণ।
“থাকা–খাওয়ার যে অবস্থা—সেখানে ঈদের কথা ভাবার সুযোগই নেই,” ঈদের প্রস্তুতির কথা জানতে চাইলে গত বুধবার বেনারকে বলেন টেকনাফের মৌচনী নতুন রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা আমিনা খাতুন।
আমিনা জানান, ভালো পানির ব্যবস্থা নেই। বাথরুমের সুব্যবস্থা নেই। এই পরিস্থিতিতে ঈদের দিন আর সাধারণ দিনের পার্থক্য করা যাবে না। শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে যখন তিনি বেনারের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন ছেলেটির গায়ে দূরে থাক, পরনেও পোশাক ছিল না।
মিয়ানমার হাসসুরাতা গ্রামের বাসিন্দা এ রোহিঙ্গা নারী বলেন, “দেখুন, টাকার অভাবে ছোট ছেলেটিকে জামা কিনে দিতে পারিনি, ঈদেও পারব না। পেটের খাবার তো সবার আগে।”
আট মাস আগে রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গুলিতে স্বামীকে হারানোর পরে আট সন্তান নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে এই শিবিরে আশ্রয় নেন আমিনা খাতুন। আগামী ১৬ জুন তাঁর মতো কক্সবাজারে নতুন আসা প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গার প্রথম ঈদ।
গত বছর ঈদ উদযাপনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, রাখাইনে স্বামী কালা মিয়ার সঙ্গে গত বছর ঈদ করেছিলেন। গর্জন কাঠ দিয়ে তৈরি বাড়িতে থাকতেন। গত ঈদে ২০ কেজি গরুর মাংস রান্না করেছিলেন। আত্মীয়-স্বজনদের আপ্যায়ন করেছিলেন চালের গুড়া দিয়ে তৈরি রুটি ও গরুর মাংস দিয়ে।”
“নতুন জামা পরে সেদিন রিকশায় মংডু শহরে ঘুরেছিল ছেলেমেয়েরা। সেসব এখন শুধু স্মৃতি। এবার ছেলেদের নতুন জামা দেওয়া দূরের কথা, ঠিক মতো খাবার দেওয়া নিয়ে চিন্তায় আছি,” বলেন আমিনা।
টেকনাফের মৌচনী রাস্তার পূর্ব পাশে নতুন রোহিঙ্গা শিবিরের মাঝি হামিদ উল্লাহ বেনারকে বলেন, “মাস খানেক আগে গড়ে উঠা এই নতুন রোহিঙ্গা শিবিরে প্রায় দুই’শ ঘরে ৮ হাজার মানুষ রয়েছে। এতো মানুষের জন্য নেই কোনো টয়লেট বা খাবার পানির ব্যবস্থা।”
“কখনো ত্রাণ পাই, কখনো পাই না। কয়েকদিন পর ঈদ। শিবিরের ছোট বাচ্চারা নতুন জামার জন্য বায়না করছে। গত বছর মিয়ানমারে আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে ভালোভাবেই ঈদ উদযাপন করেছিল এদের অনেকেই। আর এখন চিন্তার শেষ নেই,” বলেন তিনি।
প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের রাখাইনে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সেনা নির্যাতনের ফলে গত ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা এসেছে। পুরানোসহ উখিয়া ও টেকনাফের ৩০টি শিবিরে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে।
বহিরাগমন বিভাগ ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত ১১ লাখ ১৭ হাজার রোহিঙ্গার নিবন্ধন শেষ হয়েছে। তবে বর্তমানে রোহিঙ্গা নিবন্ধন বন্ধ রয়েছে।
গত দুই মাস আগে উখিয়ার মধুরছড়া রোহিঙ্গা শিবিরে ছেলে সন্তান জন্ম দিয়েছেন ওমহে আরা (২৭)। একমাত্র ছেলের প্রথম ঈদে নতুন জামা কিনে দেবেন কীভাবে সেই চিন্তা তাঁর। আরও পাঁচটি মেয়ে রয়েছে তাঁর।
ওমহে আরা বেনারকে বলেন, “মিয়ানমারে স্বামী আবদুল হাসিমের তিন তলা কাঠের বাড়ি ছিল। ছিল তিন একর জমির চিংড়ি ঘের। এখন সব হারিয়ে ঝুপড়ি ঘরে থাকতে হচ্ছে।”
“গত বছরের এই ঈদে প্রত্যেক সন্তানকে নতুন জামা দিয়েছিলাম, কিন্তু এপারে আসার পর থেকে নিয়মিত তাদের জন্য খাবার জোগাড় করতে পারছি না,” জানান ওই নারী।
রোহিঙ্গা আলী আকবর (৫৫) বেনারকে বলেন, “ভাবছি একটি মাত্র ছোট ছেলেকে কিছু ত্রাণ বিক্রি করে নতুন জামা কিনে দেবো।”
এদিকে রমজান ও ঈদ উপলক্ষে স্থানীয় দরিদ্রদের পাশাপাশি রোহিঙ্গারাও সাহায্যের আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।
টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মোহাম্মদ আলী বেনারকে বলেন, “ঈদের আগে প্রতি বছর গরিবদের কিছু সাহায্য করে থাকি। এবার রোহিঙ্গা আসার ফলে চাপটা অনেক বেশি। অবস্থাটা কাকে রেখে, কাকে দেব—এমনই।”
টেকনাফ উপজেলা রোহিঙ্গা শিবিরের হেড মাঝি আলী জোহার বলেন, “আমার দায়িত্বে থাকা ৯ হাজার পরিবারের সবাই অনেক কষ্টে রয়েছে। সবার মনেই দুঃখ, ঈদের আনন্দ আসবে কোথা থেকে।”
মাঝি জানান, ঈদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা হচ্ছে বর্ষা শুরু হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসবে। তখন এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার কী হবে?
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য ঈদ উপলক্ষে আলাদা বরাদ্দ নেই। তবে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার কিছু কিছু বরাদ্দ রয়েছে।
এদিকে ঈদ উপলক্ষে সরকারের পক্ষ থেকে একটি বরাদ্দ আসার কথা রয়েছে বলে বেনারকে জানান টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রবিউল হাসান।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বেনারকে বলেন, “ঈদ উপলক্ষ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য সরকারি বরাদ্দ এখন পর্যন্ত আসেনি। তবে বিভিন্ন এনজিও’র পক্ষ থেকে তাদের জন্য ঈদ উপলক্ষে বিশেষ বরাদ্দ রয়েছে।”