বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই ভূমিধসে রোহিঙ্গা শিশুর মৃত্যু

জেসমিন পাপড়ি ও আবদুর রহমান
2018.06.11
ঢাকা ও কক্সবাজার
উখিয়ার মধুরছড়া শরণার্থী শিবিরে কাদামাখা পথ পেরিয়ে কাঁধে ত্রাণের বস্তা নিয়ে যাচ্ছে দুই রোহিঙ্গা শিশু। উখিয়ার মধুরছড়া শরণার্থী শিবিরে কাদামাখা পথ পেরিয়ে কাঁধে ত্রাণের বস্তা নিয়ে যাচ্ছে দুই রোহিঙ্গা শিশু। ১১ জুন ২০১৮।
আবদুর রহমান/বেনারনিউজ

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গা ভূমিধসের ঝুঁকিতে রয়েছে। বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই গত দুই দিনের বৃষ্টিতে প্রায় চার হাজারেরও বেশি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে।

এদিকে পাহাড় ধসে উখিয়ায় রোহিঙ্গা শিবিরে মারা গেছে তিন বছরের এক শিশু। মো. সুলতান নামের শিশুটির মাও আহত হয়েছেন। বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন বলছে, গত তিনদিনের বৃষ্টিতে ভূমিধসে আহত হয়েছে শরণার্থী শিবিরের পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গা।

উখিয়া থানার ওসি আবুল খায়ের বেনারকে বলেন, “সোমবার ভোরে ভারী বৃষ্টিপাতে কুতুপালং টিভি টাওয়ারে পেছনে রোহিঙ্গা শিবিরে পাহাড়ের একটি ঝুপড়ি ঘরের মাটির দেয়াল ধসে পড়লে ঘরটিতে থাকা ৩ বছরের শিশুটি মারা যায়। শিশুটির আহত মাকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।”

এদিকে ভূমিধস, বন্যা, সাইক্লোনসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করতে উখিয়া-টেকনাফের পাহাড় ও বনে চরম ঝুঁকির মুখে বসবাসকারী চার শতাধিক রোহিঙ্গা পরিবারকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়েছে বলে বেনারকে জানান কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সাইফুল আশ্রাব।

তিনি গতকাল সোমবার বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গারা পাহাড় ও গাছ কেটে যেভাবে ঘর নির্মাণ করেছে, তাতে ভয়াবহ ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে। ইতিমধ্যে ভূমিধস শুরুও হয়েছে।”

তিনি জানান, উখিয়া-টেকনাফে ৩০টি রোহিঙ্গা শিবির রয়েছে। বলতে গেলে সবগুলো ঝুঁকিতে। তবে অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ১ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা পরিবারকে চিহ্নিত করা হয়েছে। যার লোকসংখ্যা ছয় লাখ।

“বর্ষা মৌসুমে ওই সব পরিবার ভূমিধসের মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে সতর্ক করে গত মে মাসে জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিতে বলা হয়,” বলেন সাইফুল আশ্রাব।

গত বছর ২৫ আগস্ট থেকে প্রাণে বাঁচতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে কক্সবাজার এসে উখিয়া-টেকনাফের পাহাড় ও বন উজাড় করে বসতি শুরু করে।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এবং এশীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি কেন্দ্রের এক যৌথ গবেষণায় দেখা যায় যে, এদের মধ্যে দুই লাখ রোহিঙ্গা এবারের বর্ষায় বন্যা এবং ভূমিধসের ঝুঁকিতে রয়েছে।

এর আগে গত বছর জুন মাসে টানা বৃষ্টিতে মাটি চাপা পড়ে রাঙামাটি, বান্দরবান ও চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে ১৩০ জন নিহত হন। এর মধ্যে রাঙামাটিতে চার সেনাসহ ৯৮ জন, বান্দরবানে ৭ জন এবং চট্টগ্রামে ২৫ জন মারা যান।

এ ধরনের ঘটনা এড়াতে রোহিঙ্গা শিবিরের প্রস্তুতি সম্পর্কে শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বেনারকে বলেন, “দুই দিন ধরে বৃষ্টির শুরু হওয়ায় শিবিরে ছোট-খাটো ভূমিধসের ঘটনা ঘটছে। এতে বেশ কিছু রোহিঙ্গার ঘর বিধ্বস্ত হলেও বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। আমরা দুর্যোগের ক্ষতি এড়াতে সচেষ্ট রয়েছি।”

“তা ছাড়া গত দুই দিনে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকে উখিয়া-টেকনাফে প্রায় চার শতাধিক রোহিঙ্গা পরিবারকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বাকিদের পর্যায়ক্রমে সরিয়ে নেওয়া হবে,” বলেন তিনি।

কুতুপালং মধুরছড়া রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা নুর হাকিম বেনারকে জানান, শনিবার সকাল থেকে ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে শুরু হয় বৃষ্টি। ঝোড়ো হাওয়ায় ব্লকের আবুল কালাম, আবুল বসর, মো. ইব্রাহিম, মো. ছিদ্দিক, মো. ইয়াকুব, মো. ইউনুছ ও আয়াছসহ শতাধিক ঘর বাতাসে উড়ে যায়। আবার অনেকের ঘর দেবে গেছে। ক্ষতিগ্রস্তরা স্বজনদের ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন।

টেকনাফের হোয়াইক্যং পাহাড়ে রোহিঙ্গাদের ঝুঁকিপূর্ণ বসতি। ১১ জুন ২০১৮।
টেকনাফের হোয়াইক্যং পাহাড়ে রোহিঙ্গাদের ঝুঁকিপূর্ণ বসতি। ১১ জুন ২০১৮।
আবদুর রহমান/বেনারনিউজ
জেলা বন সূত্রে মতে, কুতুপালং, থাইংখালী ও আশপাশের পাহাড়ের প্রায় তিন হাজার একর জায়গায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয়কেন্দ্র করা হয়েছে। এ ছাড়া টেকনাফ রেঞ্জে ৪৫০ একর, পুটিবুনিয়া রেঞ্জের ৫০ একর এবং শীলখালী রেঞ্জের ৩৭৫ একর পাহাড়ি বন কেটে রোহিঙ্গা বসতি করা হয়েছে। মোট পাহাড়ি জমির পরিমাণ ৩ হাজার ৮৭৫ একর।

এ ছাড়া টেকনাফের নেচার পার্ক, লেদা, বাহারছড়া, শাহপরীর দ্বীপ, মোচনী, দমদমিয়া, জাদিমুরা, মেরিন ড্রাইভ এলাকা এবং উখিয়ার জামতলি, মধুরছড়া ও বাগগোনসহ বিভিন্ন স্থানে আরও তিন হাজার একর জায়গাতে ঝুপড়িঘর তুলে ছোট বড়-মাঝারি আকারের বসতি করছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, প্রধান সড়ক থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার ভেতরে টেকনাফ উপজেলায় হোয়াইক্যং ইউনিয়নের পুটিবুনিয়া পাহাড়ের গাছপালা কেটে ধাপে ধাপে গড়ে উঠেছে রোহিঙ্গা শিবির। গত দুই দিনে সামান্য বৃষ্টিতে ভূমিধসে প্রায় শতাধিক ঝুপড়ি ঘর ভেঙে গেছে। কর্দমাক্ত রাস্তাঘাটে চলাফেলার সময়ও দুর্ঘটনা ঘটছে।

পুটবুনিয়া উঁচু পাহাড়ে ঘর করেছেন মিয়ানমার সিডং গ্রামের মোস্তফা খাতুন। তিনি বেনারকে বলেন, “গত দুই দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে তাতে আবারও মৃত্যুর ভয় তাড়া করছে। কোথাও জায়গা না পেয়ে এই উঁচু পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম। কিন্তু যেকোনো মুহূর্তে এখানে ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। বৃষ্টি হলে নির্ঘুম রাত কাটে।”

আবদুল হামিদ নামে এক রোহিঙ্গা বেনারকে জানান, বৃষ্টির পানি ঢুকে তার ঘর তলিয়ে যাওয়ায় এখন অন্যের ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন।

কক্সবাজারের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) প্রধান নির্বাহী এম ইব্রাহিম খলিল মামুন বেনারকে বলেন, “মানবিক কারণে আমরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি। তবে পাহাড়গুলো কেটে তারা যে হারে ঘর নির্মাণ করেছে, তাতে পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।”

“সামান্য বৃষ্টিতে এখন ভূমিধস শুরু হয়েছে। এসব ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকে রোহিঙ্গাদের না সরালে বড় ধরনে প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে,” বলেন তিনি।
“উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরের যেসব জায়গাতে ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। গত দুই দিনে চার শতাধিক রোহিঙ্গা পরিবারকে অন্যত্রে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বাকিদেরও সরিয়ে নেওয়ার কাজ চলছে,” বেনারকে বলেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।