রোহিঙ্গারা ভবিষ্যতে দেশের নিরাপত্তা-হুমকি হয়ে উঠতে পারে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

কামরান রেজা চৌধুরী
2017.06.15
ঢাকা
কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের পাশে কুতুপালং এলাকায় এভাবেই অস্থায়ী আবাস তৈরি করে বসবাস করছে রোহিঙ্গারা কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের পাশে কুতুপালং এলাকায় এভাবেই অস্থায়ী আবাস তৈরি করে বসবাস করছে রোহিঙ্গারা। জুন ০২, ২০১৭।
জেসমিন পাপড়ি/বেনারনিউজ

রোহিঙ্গারা ভবিষ্যতে দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে বলে বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদকে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এছাড়া রোহিঙ্গারা বর্তমানে কক্সবাজার জেলার মোট জনসংখ্যার ২০ থেকে ২৫ ভাগ বলেও জানান তিনি।

এদিকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে রোহিঙ্গাদের নতুন একটি সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠীর উপস্থিতির কথা জানিয়েছে জাকার্তা ভিত্তিক এক গবেষণা প্রতিবেদন।

“রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জন্য কী ধরনের ক্ষতি বা সমস্যার সৃষ্টি করছে?”— সংসদে এ কথা জানতে চান আওয়ামী লীগ সাংসদ ইস্রাফিল আলম।

জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, “এই বিপুলসংখ্যক রাখাইন প্রদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী ভবিষ্যতে নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।”

তিনি বলেন “সর্বোপরি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও পরিবেশগত ব্যাপক ক্ষতি সাধন করছে।”

মন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে মাদকদ্রব্য পাচার, অস্ত্র ও মানব পাচার, চোরাচালানসহ বিভিন্ন ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত রয়েছে। তারা সীমান্ত এলাকায় একটি অপরাধচক্র তৈরি করে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা, জাতীয় পরিচয় ও আর্থসামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে।

রোহিঙ্গারা এ অঞ্চলে স্থানীয় শ্রম বাজার ও কর্মসংস্থানেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে উল্লেখ করেন মন্ত্রী।

এছাড়া এই বিপুলসংখ্যক নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিয়ানমারের অধিবাসীরা বিভিন্ন স্থানে বসবাস করে বাংলাদেশের ভূমির ক্ষতি করছে, গাছপালা নষ্ট করছে, পরিবেশের ক্ষতি করছে। এমনকি তারা বিভিন্ন প্রকার অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

কক্সবাজারের ২০-২৫ ভাগ বাসিন্দা রোহিঙ্গা

সংসদে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, কক্সবাজারসহ পার্শ্ববর্তী চারটি জেলায় সাড়ে তিন লাখ থেকে চার লাখ অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা অবৈধভাবে বসবাস করছে।

এদিকে কক্সবাজার জেলার তথ্য কর্মকর্তা নাছির উদ্দিন বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, কক্সবাজার জেলার মোট জনসংখ্যা এখন ১৬ লাখের কিছু বেশি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে মিয়ানমারের সীমান্ত চৌকিতে সন্ত্রাসী হামলা ও পরবর্তী সামরিক অভিযানের পর থেকে প্রায় ৭৫ হাজার মিয়ানমারের নাগরিক নতুনভাবে প্রবেশ করেছে।

এ ছাড়া জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক হাই কমিশন পরিচালিত দুই নিবন্ধিত ক্যাম্পে ৩৩ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বসবাস করছে।

এর আগে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের বর্তমান সংখ্যা মোট চার লাখ তিন হাজারের কিছু বেশি বলে জাতিসংঘে জানিয়েছিল বাংলাদেশ।

এপ্রিলের শুরুর দিকে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের এই হালনাগাদ তথ্য উপস্থাপন করেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি।

তবে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী সংসদে গত বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গাদের চট্টগ্রাম অঞ্চলের একমাত্র সমস্যা বলে মন্তব্য করেন।

“বৃহত্তর চট্টগ্রামের একমাত্র সমস্যা হলো রোহিঙ্গা,” বলেন চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত এই সাংসদ ও বর্তমান প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী।

এদিকে কক্সবাজার জেলায় স্থানীয় জনগণের মধ্যে রোহিঙ্গা বিরোধী মনোভাব খুব জোরালো। ইতিমধ্যে সেখানে রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়েছে বলে বেনারকে জানান রামু উপজেলার বাসিন্দা সুনীল বড়ুয়া।

“রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানো না গেলে ভবিষ্যতে কক্সবাজারে সাংঘাতিক সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেবে। এমনকি জাতিগত সংঘাত ও ঘটতে পারে,” তিনি বলেন।

শরণার্থী বিষয়ক বিশ্লেষক আসিফ মুনীর বেনারকে বলেন, রোহিঙ্গা মুসলিমরা তাদের জাতি-ধর্ম ও বিশ্বাসের কারণে মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আবার বাংলাদেশ সীমান্তে কড়াকড়ি করছে যেন তারা প্রবেশ করতে না পারে।

“তাই তারা জীবন বাঁচাতে যে যেভাবে পারছে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। ফলে যারা প্রবেশ করছে তারা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে,” মুনীর বলেন।

তাঁর মতে, সরকারের উচিত আগত রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক তথ্যসহ একটি ডাটাবেস তৈরি করা। এর মাধ্যমে তাদের ভবিষ্যতে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া সহজ হবে।

কক্সবাজারের সাবেক সাবডিভিশনাল অফিসার ও রাষ্ট্রদুত আশফাকুর রহমান বেনারকে বলেন, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেনানো প্রায় অসম্ভব।

“সরকারের উচিত মিয়ানমার সরকারের ওপর কূটনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখা যাতে রাখাইন প্রদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে। সেখানে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হলে রোহিঙ্গারা আমাদের এখানে আসবে না। একই সঙ্গে বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে,” আশফাকুর রহমান বলেন।

গত মে মাসে জাতিসংঘ বৌদ্ধ অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন তদন্তে একটি মিশন নিয়োগ করে।

গত ১২ জুন সুইডেনে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচি এই মিশন প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, এর ফলে রাখাইন রাজ্যে জাতিগত সহিংসতা আরও বৃদ্ধি পাবে। রোহিঙ্গা নির্যাতনের প্রেক্ষাপটে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী সুচির এই পুরস্কার নিয়েও প্রশ্ন তোলেন সাংবাদিকেরা।

সীমান্তে রোহিঙ্গাদের নতুন সশস্ত্র সংগঠন

বাংলাদেশ- মিয়ানমার সীমান্তে রোহিঙ্গাদের নতুন একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে জাকার্তা ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্সটিটিউট ফর পলিসি অ্যানালাসিস (আইপ্যাক)।

এই গোষ্ঠীটি আগে হারকাত আল-ইয়কিন নামে পরিচিত হলেও চলতি বছরের মার্চে তারা নাম পরিবর্তন করে ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ (আরসা) নামে আত্মপ্রকাশ করেছে বলে মে মাসে প্রকাশিত আইপ্যাকের প্রতিবেদনটি জানায়।

বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে মিয়ানমার পুলিশের তিনটি চেকপোস্টে গত অক্টোবর সশস্ত্র রোহিঙ্গাদের আক্রমণের ঘটনার পর এই গোষ্ঠীটির কথা প্রথম জানা যায়। এই আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমার বাহিনীর অভিযানের প্রেক্ষিতে হাজারো রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়।

আইপ্যাক প্রতিবেদন মতে “সীমান্তে মিয়ানমার নিরপত্তা বাহিনীর ওপর আক্রমণের উদ্দেশ্যে সংগঠিত হওয়া সশস্ত্র রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর উপস্থিতি বাংলাদেশে আইএস মাতাদর্শের অনুসারী গোষ্ঠীগুলোকে উৎসাহিত করতে পারে।”

এছাড়া ইসলামিক স্টেট এর পাশাপাশি শিক্ষার্থী, অভিবাসী শ্রমিক ও শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয় দেশগুলোর নাগরিকদের এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাতায়ত এই অঞ্চলের চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সম্পর্ককে আরো সংহত করছে বলেও জানায় প্রতিবেদনটি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।